সংখ্যাটি অবাক করিবার মতো। এক বৎসরেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটিয়াছে এক হাজার এক শত বিয়াল্লিশটি পুলিশ এনকাউন্টারের ঘটনা। তাহার ফলে গত জানুয়ারি অবধি ৩৪ জনের মৃত্যু, আড়াই শতেরও বেশি গুরুতর আহত। যোগী আদিত্যনাথের শাসনে উত্তরপ্রদেশ সত্যই নজর কাড়িতেছে। প্রায় প্রতিটি নিধনের ক্ষেত্রে কারণ দেখানো হইয়াছে একেবারে এক, একই ভাষায় তাহা লেখা পর্যন্ত— অনেকে সন্দেহ করিতেছেন, অধিক পরিশ্রম কিংবা ভাবনাচিন্তা পরিহারপূর্বক ‘কাট-পেস্ট’ নামক আধুনিক জনপ্রিয় প্রযুক্তিপদ্ধতির সহায়তাতেই কাজটি করা হইয়াছে। কোনও কোনও নিহত ব্যক্তির পরিবার ইতিমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিকট অভিযোগ পেশ করিয়াছেন, যদিও কমিশন এখনও কোনও উচ্চবাচ্য করে নাই। অভিযোগসমূহে প্রকাশ যে, একাধিক নিহত ব্যক্তির পরিবারের বিরুদ্ধে এখনও লাগাতার হামলা-হুমকি চলিতেছে। সব মিলাইয়া যে ছবিটি ফুটিয়া উঠে, তাহাকে গণতান্ত্রিক দেশের উপযুক্ত আইনের শাসন বলা যায় না। অথচ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিধানসভায় প্রবল দাপটে ঘোষণা করিয়াছেন, পুলিশের এনকাউন্টার চলিবেই। যোগীর একটি মস্ত সুবিধা— গণতন্ত্র বা আইন-বিচার ইত্যাদি সামান্য ভয়ে তিনি দমেন না, কেননা একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক রক্ষাকবচ তাঁহাকে সর্বদা ঘিরিয়া থাকে। সংঘ এবং বিজেপির যুগপৎ আশীর্বাদ তাঁহার মস্তকে সতত বর্ষিত হয়। আইনকানুন ইত্যাদি সামান্য বস্তু সেই আশীর্বাদের বলয়ে ঠিকরাইয়া ছিটকাইয়া যায়।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশের দাবি, এনকাউন্টারের বাড়বৃদ্ধিতে অপরাধীদের শায়েস্তা করা পূর্বাপেক্ষা সহজতর হইতেছে। সরকারি মতে, বিভিন্ন জায়গায় অপরাধীরা নাকি সুড়সুড় করিয়া ধরা দিতেছেন, ক্ষমা চাহিতেছেন, অপরাধ স্বীকার করিতেছেন। সরকারি দাবি যদি সত্যও হয়, তাহা হইলেও দুশ্চিন্তার প্রভূত কারণ। ভয়ের শাসন প্রবর্তন করিয়া শৃঙ্খলা স্থাপন করিবার পন্থাটি প্রাচীন বা মধ্য যুগে যেমন চলিত, আধুনিক যুগে ততটা চলে না। বেচাল দেখিলেই গুলি করিব, তাই বেচাল করিয়ো না: অপরাধীদের এই বার্তা দিয়া যদি যোগী আদিত্যনাথরা ভাবেন, দারুণ প্রশাসন চালাইতেছেন, তবে ভুল করিতেছেন। গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে যদি এতখানি অগণতান্ত্রিক হিংসা চারাইয়া দেওয়া হইলে তাহার বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রবল ও তীব্র হইতে বেশি সময় লাগে না। দৃষ্টান্ত হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজত্বের শেষ দিকের পুলিশি যথেচ্ছাচারের কথা ভাবা যাইতে পারে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মহোৎসাহে পুলিশকে মানবাধিকারের চিন্তা উড়াইয়া দিবার পরামর্শ দিয়াছিলেন। ফল: আত্মঘাত।
যোগী সরকারের বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি সমালোচনার সুর ক্রমশ চড়াইতেছে। মুশকিল হইল, এই বিষয়ে সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক ও নেতাদের ট্র্যাক রেকর্ড মোটেই ভাল নয়। পূর্বতন সরকারের আমলে রাজনীতিকদের সহিত অপরাধী চক্রের যে দহরম-মহরম ছিল, এখন তাহা ব্যুমেরাং হইবার জোগাড়। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যখন মুচকি হাসিয়া বলেন, ওই জন্যই উহারা অপরাধ দমন করিতে ব্যর্থ হইয়াছিল, রাজ্য জুড়িয়া অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য স্থাপিত হইয়াছিল, তখন কথাটিকে মিথ্যা বলা কঠিন হয়। তালেগোলে মানবাধিকারের প্রশ্নটি রাজনৈতিক চাপান-উতোরের তলায় পড়িয়া খাবি খায়। এমনকী যোগী আদিত্যনাথ ইহাও ঘোষণা করিতে পারেন যে, সমাজবাদী পার্টি এনকাউন্টারের বিরোধিতায় যে-ভাবে হল্লা করিতেছে, তাহা নাকি ‘অসাংবিধানিক’। বাস্তবিক, সাংবিধানিকতার কথা অন্তত যোগীর কণ্ঠে শোভা পায় না। তাঁহার শাসন অপরাধচক্র কিছুটা ভাঙিতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র দাবি করিবে, অপরাধ দমনের পথটি নীতিসম্মত হওয়া দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy