Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

গণতন্ত্রের তুর্কি নাচন

তুরস্ক আর এক বার প্রমাণ করিল, গণতন্ত্র বস্তুটির মধ্যে প্রগতি ও স্বাধীনতার দিকে উৎসারণের কোনও নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নাই। অনেক জটিল ও নিহিত সম্ভাবনা লুকাইয়া এই তন্ত্রের মধ্যে: গণতন্ত্রের দুর্মর গতিতে সভ্যতার মুক্তির অভিমুখ লইয়া সম্ভবত খানিক অকাল-উচ্ছ্বাসেই মাতামাতি করিয়াছিল বিংশ শতক।

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

তুরস্ক আর এক বার প্রমাণ করিল, গণতন্ত্র বস্তুটির মধ্যে প্রগতি ও স্বাধীনতার দিকে উৎসারণের কোনও নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নাই। অনেক জটিল ও নিহিত সম্ভাবনা লুকাইয়া এই তন্ত্রের মধ্যে: গণতন্ত্রের দুর্মর গতিতে সভ্যতার মুক্তির অভিমুখ লইয়া সম্ভবত খানিক অকাল-উচ্ছ্বাসেই মাতামাতি করিয়াছিল বিংশ শতক। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এর্দোগান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণ-ভোটের মাধ্যমেই নিজের ক্ষমতার পরিধি বিপুল ভাবে বাড়াইয়া লইলেন। যাহা দাঁড়াইল, তাহাকে বাস্তবিক আর গণতন্ত্র বলিয়া অভিহিত করা মুশকিল। বরং পশ্চিম এশিয়ার বহু-পরিচিত একনায়কতন্ত্রেরই আর একটি রূপ এখন তুরস্কে। ১৯৫৩ সাল হইতে েদশটিতে নানা বাধাবিপত্তি পার হইয়া গণতান্ত্রিক শক্তি বিকাশ লাভ করিয়া আসিতেছে। সংবাদমাধ্যম, বিচারবিভাগ, শাসনবিভাগের পারস্পরিক বিরোধিতা ও সহাবস্থানে একটি সক্রিয় গণতান্ত্রিক পরিসর তৈরি হইয়া উঠিয়াছে। গত কয়েক বৎসর যাবৎ অবশ্য সামরিক পক্ষ ও অসমারিক শাসনকর্তৃত্বের সংঘর্ষে শাসক পক্ষের হাত শক্ত হইয়াছে, তাহারই চূড়ান্ত প্রকাশ এই গণভোট। এর্দোগানের নেতৃত্বে এই রেফারেন্ডাম কিংবা গণভোটকে ‘ঐতিহাসিক’ অভিধা দেওয়া হইবে কি হইবে না, সে বিষয়ে বিতর্ক চলিতে পারে। এই জয় সামান্য ভোটের ব্যবধানেই অর্জিত, এর্দোগান তাঁহার নিজস্ব তিনটি নাগরিক ঘাঁটিতে (ইস্তানবুল, আঙ্কারা, ইজমির) পিছাইয়া পড়িয়াছেন, এই সব তথ্যপ্রমাণ গণতন্ত্রের সপক্ষে যায়, এই মর্মে আলোচিত হইতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানিতেই হইবে যে তুরস্কের রাজনীতি আপাতত একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের সামনাসামনি দাঁড়াইয়াছে। প্রত্যাবর্তনের পথ অসম্ভব না হইলেও, দুরূহ।

লক্ষণীয়, এই অভিমুখ পরিবর্তন কিন্তু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সূচিত হইল না, কাহাকেও ঘাড় ধরিয়া ভোট দিতে বাধ্য করা হইল না। মোটের উপর মুক্ত পরিবেশে তুরস্কের জনসাধারণ ভোট দিয়া তাঁহাদের পরাক্রমী নেতার হাত শক্ত করিতে মনস্থ করিলেন। ইহা ইউরোপের উন্নাসিকতা ও ই ইউ-এ অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা বিলোপের প্রতিক্রিয়া হইতে পারে। ইহা দেশের অভ্যন্তরে ইসলামি নেতৃত্বের প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন হইতে পারে। এমনকী ইহা প্রেসিডেন্ট এর্দোগানের বিরুদ্ধে কয়েক বৎসর আগে যে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রবল প্রয়াস ঘটিয়াছিল, তাহার বিরুদ্ধে জনতার রায়ও হইতে পারে। তবে আসল কথা, ইহা জনতারই রায়। গণতন্ত্র যদি মানিতে হয়, এই রায়ের ফল যতই অপছন্দ হউক, কাঁদাকাটি করিলে চলিবে না। জনগণ যদি একনায়ককেই চান, তাহা হইলে সে রায় মাথা পাতিয়া লইতে হইবে।

পথটি গণতান্ত্রিক, আর গন্তব্যটি অগণতান্ত্রিক হইলে তাহাকে কি গণতন্ত্র বলা চলে? অথবা তাহাকে কি জনমঙ্গলদায়ক রাজনীতি বলা চলে? এই ধাঁধার উত্তর এখনই হাতেনাতে দেওয়া যাইবে না। তবে এই অবকাশে মানিতে হইবে, পথটি গণতান্ত্রিক বলিয়াই পথ পরিবর্তনের পথটিকেও বন্ধ বলা যায় না। হয়তো তুরস্কের মানুষ অচিরেই ভিন্ন মতে পৌঁছাইবেন। ভিন্ন পরিস্থিতির পক্ষে ভোটোদ্যত হইয়া উঠিলেন। সেখানে একটি সংশয়: প্রায়-একনায়ক প্রেসিডেন্ট ইত্যবসরে মুক্ত মতদানের রাস্তাগুলি বন্ধ করিয়া দিবেন না তো? ফরাসি বিপ্লবের সময়ও কিন্তু এমনই হইয়াছিল। প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়া নির্বাচিত নেতা যে-ই একচ্ছত্র অধিপতি হইয়া উঠিলেন, তাঁহাকে রোধ করার পথ জনগণের হাতের নাগালের বাহিরে চলিয়া গিয়াছিল। ইতিহাসের দিক হইতে কৌতূহলটি তাই এই রকম: গত কয়েক দশকের গণতান্ত্রিক পরিবেশ কি এমন কিছু অর্জন করিতে পারিয়াছে, যাহাতে গণতন্ত্রের অন্তর্ঘাত ভিতর হইতে বন্ধ করিবার আশা আছে? উত্তরের জন্য তুরস্কের ভবিষ্যৎ দেখা ছাড়া উপায় নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

promise Democracy freedom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE