Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সমালোচনা আছে, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতায় মমতা এখনও শীর্ষে

বিজেপির বঙ্গজয় দূর অস্ত্

পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির ভোট বাড়ছে। হুহু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে সিপিএম এবং কংগ্রেস। কিন্তু বিরোধী বাক্সের আয়তন বাড়ছে কি? দেখা যাচ্ছে, সকলের মিলিত অবদানে যত ভোট পড়ছে, তৃণমূল একাই তার চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে। সেই ব্যবধান বাড়ছে বই কমছে না।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ছোট রাজ্য, বড় রাজনীতি। ত্রিপুরায় বিজেপি-ঝড়ে সিপিএম গুঁড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে এটাই এখন একমাত্র চর্চার বিষয়। প্রায় পঁচিশ বছরের শাসক সিপিএম-কে হারানোই শুধু নয়, দু’বছরের মধ্যে উল্কার গতিতে বিজেপির উঠে আসা এবং কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে তার সবটুকু নিঃশেষে শুষে নেওয়ার রসায়নটা এই মুহূর্তে আরও বড় আলোচনার বস্তু। আর সেখানে অনিবার্য প্রসঙ্গ হিসাবে এসে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ।

প্রশ্ন উঠছে, ত্রিপুরায় বিজেপির অভ্যুত্থান পশ্চিমবঙ্গে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? এই রাজ্যেও কি পালাবদলের দিন আসন্ন? বিজেপি অবশ্য সেই রণহুংকার তুলে দিয়েছে। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও আছে অনেক রকম। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা মানলে বলতেই হবে, উত্তরটা বিরোধীদের পক্ষে এখনও পর্যন্ত উৎসাহবর্ধক নয়।

সন্দেহ নেই, ত্রিপুরায় এ বারের পালাবদল ২০১১-র পশ্চিমবঙ্গে বাম-বিদায়ের স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। সিপিএমের চৌত্রিশ বছরের রাজ্যপাট উলটে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাস গড়েছিলেন। এ বার চব্বিশ বছর ক্ষমতায় থাকা সিপিএমকে কার্যত দুরমুশ করে বিজেপিও নজির গড়ল। এই জয়ের পিছনে দিল্লির ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি কতটা কাজ করেছে, কী পরিমাণ টাকার খেলা হয়েছে— সে সব অবশ্যই অভিযোগ এবং বিতর্কের উপাদান। আর ত্রিপুরার সাবেক কংগ্রেস নেতাদের ভাঙিয়ে আনার সঙ্গে-সঙ্গে দলের পুরো ভোট ব্যাংকটাই বিজেপি কী ভাবে লুটে নিয়ে জয় করায়ত্ত করতে পারল, সেটা অঙ্ক দিয়ে প্রমাণিত। তবে ভোটযুদ্ধে দিনের শেষে যে জেতে, সেই ‘বাহাদুর’। বিজেপি পেরেছে! বাহাদুরি তাদের।

তার পরেই রব উঠেছে, এ বার পশ্চিমবঙ্গ। বিজেপির বড়-মেজ-সেজ নেতারা তো বটেই, অন্য অনেকেও ইতিমধ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ত্রিপুরাজয়ীর দল অচিরে মমতার গদি টলিয়ে দেবেন। আগামী লোকসভা নির্বাচনেই প্রমাণ মিলতে পারে বলে তাঁরা আশাবাদী।

রাজনীতির গতিপথ অনেক সময়েই আশানুরূপ সরল হয় না। তার বহু বাঁক থাকে। পরতে-পরতে চমকও। পরিস্থিতি অনুযায়ী যা নিয়ত বদলায়। কিন্তু যে কোনও বড় বদল হওয়ার আগে থেকে সে সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট আভাস মেলে। তার ভিত্তিতে অনুমান করাও সহজ হয়। সেই অনুমান খুব একটা ভ্রান্ত হয় না। যেমন, মমতার কাছে সিপিএম হারতে বসেছে, বোঝা গিয়েছিল। মোদী আসছেন, দেশ জানত। ইন্দিরা হারবেন, দেওয়ালে লেখা হয়ে গিয়েছিল। এমনকী, প্রচার ও প্রভাবে এ-বার ত্রিপুরায় বিজেপি শাসক সিপিএমকে টক্কর দিয়ে নজর কাড়ছে, সেই বার্তাও ছড়িয়ে পড়েছিল ভোটের বেশ কিছু আগে। মুখে স্বীকার না করলেও মনে-মনে সিঁটিয়ে ছিল সিপিএম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো কার্যত বিজেপির জয় ঘোষণা করে দিয়েছিলেন ফল বেরোনোর আগেই। তাই ত্রিপুরার ফল একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল, বললে ভুল হবে।

এ বার পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে বিষয়টি দেখা যাক। প্রথমে ভোটের হিসাব। ত্রিপুরার ক্ষেত্রে ছবিটা স্বচ্ছ। পাঁচ বছর আগে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪২ শতাংশ ভোট। বিজেপি ১.৫ শতাংশ। এ বার সেখানে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস প্রায় সবটাই ভেঙে চলে এসেছে বিজেপিতে। ৬০টি আসনের ৪১টিতেই পুরনো কংগ্রেসি মুখ। ফলে হাত চিহ্নের ভোট নেমেছে ১.৮-এ। আর বিজেপি বেড়ে ৪৩ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির ভোট বাড়ছে। হুহু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে সিপিএম এবং কংগ্রেস। কিন্তু বিরোধী বাক্সের আয়তন বাড়ছে কি? দেখা যাচ্ছে, সকলের মিলিত অবদানে যত ভোট পড়ছে, তৃণমূল একাই তার চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে। সেই ব্যবধান বাড়ছে বই কমছে না।

২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে কংগ্রেস ও সিপিএম জোটের শোচনীয় হাল দেখা গিয়েছে। বিজেপি সেই সময় বিশেষ মাথা তুলতে পারেনি। তার পর থেকে এখানে লোকসভা ও বিধানসভার যে ক’টি উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে বাম এবং কংগ্রেস আরও তলানিতে। সেই জায়গায় মূল বিরোধী হয়ে উঠে বিজেপির ভোট আগামী দিনে হয়তো আরও খানিক বাড়বে। কিন্তু একা লড়ে তৃণমূল নিজেদের আধিপত্য যে আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, এটাও স্পষ্ট। অর্থাৎ, তৃণমূল-বিরোধী ভোট ভেঙে বিজেপির ভাঁড়ার যতই ভরুক, অঙ্কটা এখানে ত্রিপুরার মতো সহজ হওয়া এখনও পর্যন্ত দূর অস্ত্ বলেই মনে হয়।

দ্বিতীয়ত, রণকৌশল। ত্রিপুরা জয়ের জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সুনীল দেওধরকে পাঠিয়েছিলেন। ত্রিপুরায় তিনি বহিরাগত। ফলে স্থানীয় কোনও চাপ বা বাধ্যবাধকতা তাঁর ছিল না। দু’বছর ধরে সেখানে ঘাঁটি গেড়ে কাজ করছিলেন। সকলেরই বক্তব্য, দক্ষ সংগঠক সুনীলের পরিচালনায় দল এই সাফল্য পেয়েছে।

অনেকের মতে, এই রাজ্যেও ‘বহিরাগত’ কোনও নেতার উপর রণকৌশল তৈরির ভার দিলে বিজেপি লাভবান হবে। কে হবেন সেই ‘বহিরাগত’? বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের হাত কত লম্বা, জানা নেই। তবে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এখানে তাঁদের কোনও ‘সুনীল’ লাগবে না।

কিছু লোক আবার বলতে শুরু করেছেন, তৃণমূল-ত্যাগী মুকুল রায় তো বিজেপিতে সদ্য আসা এক জন ‘বহিরাগত’। বহু দিন তৃণমূলের ভোট-পরিচালক ছিলেন। সব ফাঁকফোকর তাঁর নখদর্পণে। তিনিই বা কম কিসে!

কে ঠিক, কে বেঠিক সেই তর্কে যাব না। তবে আরও এক বার বাস্তবের দিকে চোখ রেখে অবশ্যই বলব, মুকুল বিজেপিতে এসে এখনও পর্যন্ত কোনও রকম ‘দক্ষতা’র নজির রাখতে পারেননি। তৃণমূলে প্রায় মমতার মতো ‘ক্ষমতাবান’ বলে গণ্য হতেন তিনি। কিন্তু দল ছাড়ার সময় এক জনও উল্লেখযোগ্য তৃণমূল নেতাকে তিনি পাশে পাননি। ক’দিন আগেই তাঁর বাড়ির পাশের নোয়াপাড়া বিধানসভা উপনির্বাচনে মুকুলের উদ্যোগ দলকে বিড়ম্বনায় ফেলেছিল। সেই মুকুল হঠাৎ বিকশিত হয়ে বিজেপিতে ফুল ফুটিয়ে দেবেন কোন মন্ত্রবলে, বোঝা কঠিন।

তবু না হয় ধরা গেল, মুকুলকে মাঠে নামিয়ে বিজেপি দল ভাঙাবে। যদি সত্যিই তা হয়, তা হলেও যাঁরা আসবেন, তাঁরা সঙ্গে করে নিজেদের জেতার মতো ভোটটুকু নিয়ে আসতে পারবেন তো? পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক মেরুকরণের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচারটি কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কারণ বাম ও কংগ্রেসের ভোট ভাঙতে ভাঙতে বিজেপির কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে। তার পরেও তৃণমূলের সঙ্গে ফারাক বিস্তর। রাতারাতি তা ভরাট হবে কি?

আবার বলি, বড় বদল যদি আসার হয়, তার আগাম ইঙ্গিত টের পাওয়া যায়। ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক নেতিবাচক বিদ্বেষবোধ তৈরি হতে থাকে। বিরোধীপক্ষ যা ভোটে টেনে নেয়। আজকের পশ্চিমবঙ্গে এখনও তেমন কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হয় না।

শাসক তৃণমূলের সবই ভাল, তারা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা— তা কখনও বলব না। বহু অভিযোগ, বহু কলঙ্কের বোঝা তাদের মাথায় চেপেছে। মানুষ সে-সব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ক্ষোভ প্রকাশ করে। কিন্তু তা কখনও বিদ্বেষ নয়। তাই হাজার সমালোচনা করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও গ্রহণযোগ্যতায় শীর্ষে। যে কোনও জনসমীক্ষায় সেই তথ্য বেরিয়ে আসে। আর, যত দিন এই অবস্থান থাকবে, তত দিন ভোট ভাঙালেও চাকা ঘোরানো কঠিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE