একটি ইলেকট্রিক বাল্ব বদলাইতে কয় জন অর্থনীতিবিদ প্রয়োজন? পরিচিত কৌতুকটির উত্তর বলিবে, এক জনও নহে। কারণ, সত্যই যদি বাল্ব বদলাইবার প্রয়োজন থাকে, তবে বাজারের অদৃশ্য হাতই তাহা করিয়া লইবে। পল ক্রুগম্যান অবশ্য এই উত্তর দিবেন না। তাঁহার অর্থনৈতিক দর্শন বাজারকে ততখানি গুরুত্ব দিতে নারাজ। তিনি বলিবেন, অর্থনীতিকে পথ দেখাইবার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ভারতীয় অর্থনীতি সম্বন্ধে তাঁহার মতটিও এই দর্শনের অনুসারী। তিনি বলিয়াছেন, ভারতকে যদি অর্থনৈতিক বিশ্বশক্তি হইয়া উঠিতে হয়, তবে নজর দিতে হইবে ম্যানুফ্যাকচারিং বা নির্মাণ ক্ষেত্রের দিকে। ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কারের পর ভারতের বৃদ্ধি হইয়াছে মূলত পরিষেবায়। সেই বৃদ্ধির তাৎপর্য অস্বীকার করিবার প্রশ্নই নাই— ভারত গোটা দুনিয়ার ‘ব্যাক অফিস’ হইয়া উঠিয়াছিল। তুলনায় নির্মাণ ক্ষেত্র অবহেলিতই থাকিয়াছে। সেই বাজারে কোনও দেশই চিনের তুল্য হইতে পারে নাই। ভারত বস্তুত তুলনার দৌড়ে নামই লিখায় নাই। অতএব, ক্রুগম্যান যে পথে হাঁটিবার কথা বলিতেছেন, তাহার জন্য ভারতীয় অর্থনীতির গতিপথে একটি মৌলিক পরিবর্তন করিতে হইবে। বাজার কি নিজস্ব তাগিদে, এবং নিজের ক্ষমতাতেই সেই পরিবর্তন করিতে পারে? শিকাগো স্কুলের কট্টর সমর্থক ভিন্ন আর সকলেই বলিবেন, না। সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণ ক্ষেত্রটিকে বিনিয়োগের উপযোগী করিয়া তুলিতে, তাহার লাভযোগ্যতা বাড়াইতে সরকারকে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ করিতে হইবে।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ প্রান্তে দাঁড়াইয়া বকরূপী ধর্ম যদি যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করিতেন, হাওয়া অপেক্ষা দ্রুতগামী কী, জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব হয়তো উত্তর দিতেন, প্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির বিবর্তনের একটি ধাপে ভারতের পরিষেবা ক্ষেত্র বিপুল লাভবান হইয়াছিল। বিবর্তনের পরের ধাপ ছবিটি বদলাইয়া দিতেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধি আর কল্পবিজ্ঞানের গল্প নহে, তাহা ঘোর বাস্তব। এবং, পরিষেবা ক্ষেত্রে কাজের একটি বড় অংশ তাহার দখলে চলিয়া যাওয়ার আশঙ্কাটিও ক্রমে বাস্তব হইয়া উঠিতেছে। ক্রুগম্যান উল্লেখ করিয়াছেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের কাজটিও কৃত্রিম বুদ্ধির সাহায্যেই হইতে পারে। কল সেন্টারের সাদামাটা কাজের ক্ষেত্রে কী হইবে, তাহা না বলিলেও চলে। অতএব, পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃহৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ আর থাকিবে না, তাহা এক রকম নিশ্চিত। বাঁচিতে হইলে, নির্মাণ ক্ষেত্রে জোর দেওয়াই উপায়। সেখানেও কৃত্রিম বুদ্ধি হাত বাড়াইয়াছে, কিন্তু উৎপাদনে মানুষের ভূমিকা এখনও তুচ্ছ হইয়া যায় নাই।
ক্রুগম্যান প্রশ্নটিকে কর্মসংস্থানের প্রেক্ষিতে দেখিয়াছেন। রাহুল গাঁধীও। ক্রুগম্যানের বক্তৃতাটির সূত্র টানিয়া তিনি জানাইয়া দিয়াছেন, নরেন্দ্র মোদীর ‘অচ্ছে দিন’ আর আসিবে না— প্রধানমন্ত্রী বাস্তব অস্বীকার করিতে ব্যস্ত। রাজনৈতিক তরজা ভিন্ন, কিন্তু সত্য হইল, গত চার বৎসরে নরেন্দ্র মোদী ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি যত শ্রুতিমধুর নাম আমদানি করিয়াছেন, নির্মাণ ক্ষেত্রের অবস্থা ফিরাইতে তাহার সিকি ভাগও চেষ্টা করেন নাই। বৎসরে সওয়া কোটি নূতন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি ঠোঙা হইয়া গিয়াছে— যে পকৌড়া ভাজিয়াও অনেকের অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থান হইয়াছে বলিয়া প্রধানমন্ত্রীর মত, সেই পকৌড়া সম্ভবত ওই ‘ঠোঙা’তেই বিক্রয় হইবে। দীর্ঘমেয়াদে ভারত অর্থনৈতিক বিশ্বশক্তি হইবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রধানমন্ত্রীর রুচি না-ও থাকিতে পারে। আপাতত ২০১৯ সত্য। কিন্তু, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হইতে সেই বৈতরণীও কোন মন্ত্রে পার হইবেন, তিনি ভাবিয়া দেখিয়াছেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy