Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

পিপুফিশু

কিন্তু আমজনতার হৃৎকম্প হইলে কী হবে, পুর-প্রশাসন এখনও নিধিরাম সর্দার। বাড়ি পুরাতন, জরাজীর্ণ হইলে পুরসভার পক্ষ হইতে বড়জোর তাহার সামনে একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের নোটিস পড়ে।

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০৯
Share: Save:

কলকাতায় সম্প্রতি ভয়ংকর কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে নাই। তবুও শহরের মাথায় প্রায় প্রত্যহই ছাদ ভাঙিয়া পড়িতেছে। ‘বিপজ্জনক’ বাড়ির ছাদ। সাম্প্রতিক-তম সংযোজন গিরিশ পার্ক। সেখানে একটি ঝুলবারান্দা ভাঙিয়া আহত হইয়াছেন এক প্রৌঢ়া। ইহার আগে রবিবারও একটি বাড়ি ভাঙিয়া পড়ে। শনিবার বিটি-রোড সংলগ্ন টালা থানা এলাকায় একটি বাড়ি ভাঙিয়া এক জনের মৃত্যুও হইয়াছে। এই ঘটনা লইয়া গত তিন মাসে বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙিয়া মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াইল, নয়। এবং পুরসভার হিসাব বলিতেছে, শহর জুড়িয়া বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। ইহাদের সব কয়টি যদি এমন পালা করিয়া ধসিতে বসে, তাহা হইলে মৃত ও আহত মিলাইয়া সংখ্যাটি বড় কম হইবে না। স্বাভাবিক সময়েই যদি এই অবস্থা, তাহা হইলে বড় ঝড় বা ভূকম্পের পর শহরের অবস্থা কী দাঁড়াইবে, ভাবিলে হৃৎকম্প হয়।

কিন্তু আমজনতার হৃৎকম্প হইলে কী হবে, পুর-প্রশাসন এখনও নিধিরাম সর্দার। বাড়ি পুরাতন, জরাজীর্ণ হইলে পুরসভার পক্ষ হইতে বড়জোর তাহার সামনে একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের নোটিস পড়ে। ইহার অধিক কিছু নহে। নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া সেই বিপজ্জনক বাড়িতেই দিব্য চলে বসবাস, ব্যবসা। অথচ, পুরাতন, বিপজ্জনক বাড়ির ক্ষেত্রে একটি আইন আছে। আইনটি আসলে ওই সমস্ত বাড়ির মালিকদের জন্য কিছু শর্তসাপেক্ষে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা। কিন্তু তাহাতে বিশেষ কাজ হয় নাই। কাজ যাহাতে হয়, সেই উদ্যোগও নাই, ঢালাও প্রচারও নাই। শনিবারের ঘটনাটির পর অবশ্য খানিক টনক নড়িয়াছে। অবিলম্বে ওই এলাকার পুরাতন বাড়িগুলি খালি করিবার নির্দেশ জারি হইয়াছে। কিন্তু তিন হাজার জীর্ণ বাড়ি হইতে সমস্ত বাসিন্দাদের সরাইতে গেলে যে পরিমাণ সময় প্রয়োজন, তাহাতে আরও কতগুলি বেঘোরে মৃত্যুর সম্ভাবনা। সুতরাং এহেন মৃত্যুর দায় কিছুটা সরকারের উপরেও বর্তায়।

বাকি দায়টুকু অবশ্যই বাড়ির মালিক ও বাসিন্দাদের। অধিকাংশ বিপজ্জনক বাড়ির মালিকানা একাধিক শরিকের হাতে। অনেকগুলির মালিকানা লইয়া মামলা চলিতেছে। এমতাবস্থায়, বাড়িটি ভাগের মা হইয়াই থাকিয়া যায়। বাড়িকে খাটাইয়া কিছু লক্ষ্মীলাভের তাড়না তাঁহাদের মধ্যে যত প্রবল, তাহাকে বাসযোগ্য রাখিবার বেলায় তত নহে। আবার বাড়ি বিক্রয় করিতে হইলে দীর্ঘ দিনের ভাড়াটিয়াদের অনুকূলে যত সুবিধা ছাড়িতে হয়, তাহার বদলে বাড়িটি ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রাখিয়া দেওয়াই শ্রেয় বলিয়া তাঁহারা মনে করেন। অন্য দিকে, দীর্ঘ দিনের বাসিন্দারাও কম খরচে মাথাটুকু গুঁজিতে পারিলেই নিশ্চিন্ত, অন্যত্র উঠিয়া যাইবার সামর্থ্য থাকিলেও। বহু পুরাতন বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে শিকড় গাড়িয়া থাকিবার এক বিচিত্র মানসিকতা দেখা যায়। সস্তায় সুবিধাজনক এলাকায় বসবাসের সুযোগ ছাড়াও, পিছল উঠোন, নোনা-ধরা দেওয়াল, আরশোলা-শোভিত বাথরুমের মধ্যে তাঁহারা এক অদ্ভুত আত্মিক যোগ পান। এই গণ্ডি ছাড়িয়া অন্যত্র নূতন উদ্যমে সংসার পাতিবার কল্পনাও তাঁহারা করিতে পারেন না। আইন করিয়া এই মানসিকতায় বদল আসিবে না। সুতরাং এখনই ছাদ ভাঙিয়া পড়িবার ঘটনায় যে লাগাম পরিবে না, তাহা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dilapidated House Residents KMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE