অবশেষে এই দিনটিও দেখতে হল! খাস কলকাতার কেন্দ্রস্থলে প্রকাশ্য মঞ্চে ধর্মান্তরের দামামা বাজল। কতিপয় মুসলিম সেখানে ‘হিন্দু’ হলেন। ভয় হয়, আগ্নেয়গিরির উৎসমুখ কি তবে খুলে গেল? যাঁরা এ-সব করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এঁরা কী করতে চলেছেন, তার আগাম কোনও হদিশ কি পুলিশ বা ইনটেলিজেন্সের কাছেও ছিল না? যদি না থাকে, তার দায় কার? আর থাকলে কি সব জেনেও এমন উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে আগুন নিয়ে খেলার প্রশ্রয় জোগানো হয়েছিল?
পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির পরিসর থেকে সিপিএম এবং কংগ্রেস যত সরে যাচ্ছে, ততই মাথা তুলছে বিজেপি। সেই তত্ত্ব এবং তথ্য এখন আর বিশদ বলার দরকার হয় না। একের পর এক ভোটের ফলেই তা স্পষ্ট। বিজেপি তার সযত্নলালিত হিন্দুত্বের রাজনীতি শুরু করার পর থেকে শাসক তৃণমূলকেও কার্যত একই পথে হেঁটে পালটা করতে হচ্ছে। যার ফলে এই রাজ্যেও রাজনীতির ময়দানে হুহু করে ঢুকে পড়ছে ধর্মের হাওয়া। সেটাও সবাই বুঝছেন।
শুভবুদ্ধি বলে, এই হাওয়ায় আগুন থাকে। সেই আগুনে সবাই পোড়ে। হিন্দু-মুসলিম, তৃণমূল-বিজেপি কেউ পার পায় না। তবে রাজনীতির নিজস্ব ঘূর্ণিপাকে শুভবুদ্ধি তো অনেক সময় সমাচ্ছন্ন হয়। পরিণাম বিবেচনার বোধ থাকে না।
যেমন এখন। বিজেপির ফাঁদে পা দিয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে ধর্মের আমদানি বেড়ে ওঠার পর থেকেই বিষ বাসা বাঁধছে। আজ তাই হিন্দু সংহতির মতো এক উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন ধর্মতলায় মঞ্চ বেঁধে ধর্মান্তরকরণের ‘সাহস’ দেখাতে পারল! হেরে গেল সুস্থ চেতনার রাজনীতি।
এই উগ্র সংগঠনটির প্রধান তপন ঘোষ এক সময় বিশ্ব হিন্দু পরিষদে ছিলেন। পরে তৈরি করেন হিন্দু সংহতি। তিনি সাধারণত তীব্র উসকানিমূলক কথা বলতেই অভ্যস্ত। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় যে ধরণের সাম্প্রদায়িক ঘৃণার উপাদান থাকে, তাতে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে খুব অসুবিধা থাকার কথা নয়। তবে সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
ইদানীং আবার তাঁর কথাবার্তায় তৃণমূলের প্রতি খানিক প্রশ্রয়ও ধরা পড়ছে। তৃণমূল এবং হিন্দু সংহতিকে একই সঙ্গে সমর্থনের ডাকও দিয়ে থাকেন তিনি। তাঁর এই সমর্থনের ডাকে তৃণমূল আদৌ কতটা লালায়িত বা ‘লাভবান’ হতে পারে, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকবে। কিন্তু এ-কথা ঠিক যে, কোনও উগ্র হিন্দুবাদী সংগঠনের এমন আহ্বান যদি বিজেপির হিন্দু ভোট ব্যাংকে কিছুমাত্র ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয়, আখেরে সেই লাভের গুড় পৌঁছবে তৃণমূলের কলসিতেই। সে-দিক থেকে হিন্দু সংহতির ভূমিকা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
তাদের প্রতিষ্ঠা দিবসের এই বাৎসরিক সমাবেশ গত কয়েক বছরে কীভাবে বেড়ে উঠল, সেটাও নজর এড়ানোর নয়। প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি এই সমাবেশ করে আসছে সংগঠনটি। আগে সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যার বা কলেজ স্কোয়্যারের মতো ছোট জায়গায় সভা হত। গত বছর তিনেক সভাস্থল চলে এসেছে শহরের কেন্দ্রস্থল ধর্মতলার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউতে। ইলাহি আয়োজন, বাস-গাড়ি-জায়ান্ট স্ক্রিনে মঞ্চের সরাসরি ছবি, অন্তত আধ কিলোমিটার জুড়ে লাউডস্পিকার। কোথা থেকে এত টাকা এবং লোক আসে, কারা জোগায় কে জানে! আর এই আয়োজনে গলা ফাটিয়ে চলে উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক প্রচার। চলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা এবং বিষোদ্গার। সর্বোপরি প্রশাসন তাদের প্রতি বার এই রকম উত্তেজক সমাবেশ করার অনুমতিও দেয়!
এ-বারও সেটাই চলছিল। যদিও ভিড় ছিল গত বারের তুলনায় কম। কিন্তু যুক্ত হল নতুন মাত্রা—একটি মুসলিম পরিবারের সদস্য বলে চিহ্নিত কয়েক জনের প্রকাশ্যে ধর্মান্তর। আগে এমন কখনও হয়নি।
আবারও বলি, এহেন একটি কাণ্ড যে ঘটবে, তার আগাম খবর পুলিশ-গোয়েন্দাদের কাছে থাকবে না কেন? তাদের এই রকম ব্যর্থতা যে কোনও সময় ভয়াবহ হতে পারে। দায় এড়িয়ে গেলে চলবে না। আর তারা যদি জেনেও না-জানার
ভান করে থাকে, তা হলে বলতে হবে, দুরভিসন্ধির শিকড় অনেক গভীরে। সে-ক্ষেত্রে রাজ্যকে আগুনের গ্রাসে ঠেলে দেওয়ার দায়ও এই পুলিশের উপরেই এসে পড়বে।
ভাবুন তো, আজ এই উগ্র হিন্দু সংগঠন পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে নির্বিবাদে ধর্মান্তর করাল। কাল অন্য ধর্মের নামে অন্য কোনও উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাদের পক্ষে ধর্মান্তর করাতে চায়? সেটাও কিন্তু তা হলে নীতিগত ভাবে মেনে না নিয়ে উপায় থাকবে না। এবং এ-ভাবেই ক্রমশ সংঘাতের এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হবে। এই কি পশ্চিমবঙ্গ! এই কি আমাদের সম্প্রীতি, সহনশীলতার ঐতিহ্য! এই জিনিস আমরা ঘটতে দেব কেন? বিষয়টি কেন এত দূর গড়াতে দেওয়া হল? আত্মসমীক্ষায় এ-সব প্রশ্নের জবাব খুব জরুরি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। জনমতের নিরিখে তাঁর স্থান সবার উপরে। বিরোধীদের সমালোচনা করে অনেক সময়েই বলেন, তিনি তোষণের রাজনীতি করেন। কিন্তু মমতা সাম্প্রদায়িক, এমন কথা তাঁর চরম শত্রুরও বলার হিম্মত নেই।
সেই মমতার রাজ্যে হিন্দু সংহতির মতো সাম্প্রদায়িক বাহিনী যদি পা রাখার শক্ত জমি পেয়ে যায়, সেটা যুগপৎ দুর্ভাগ্যের এবং আশঙ্কার। বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরুদ্ধে তৃণমূলের লড়াইও কি তা হলে ধাক্কা খাবে না? ভেবে দেখার সময় এসেছে বলে মনে হয়। এই ধরনের উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কার্যকলাপ আর চলতে দেওয়া উচিত কি না, সেই বিবেচনার কাজ অবশ্যই প্রশাসনের। সেটা তাঁরা বুঝবেন।
পরিশেষে সাংবাদিকদের মার খাওয়ার প্রসঙ্গ। পেশাগত ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। গোলমাল, উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে ঘটনাচক্রে মার খাওয়া এই পেশায় কোনও অভিনব ঘটনা নয়। এ-রকম তো কতই হয়! কিন্তু কর্মরত সাংবাদিকদের বেছে নিয়ে ফেলে মারলে বুঝতে হয়, সেটা পরিকল্পিত আক্রমণ।
যা মাঝে-মাঝেই হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সরকারের আমলে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রোষ সাংবাদিকদের কর্মজীবনের সঙ্গী। বুধবার হিন্দু সংহতির সমাবেশেও গোড়া থেকেই সব সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ চলছিল। সাংবাদিকদের সম্পর্কে অপমানজনক মন্তব্যও বাদ যায়নি। শেষ পর্যন্ত ধর্মান্তরিত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সংহতির আক্রমণের মুখে পড়েন সাংবাদিকেরা। আহত, রক্তাক্ত এক জনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কয়েক জনের প্রাথমিক চিকিৎসা হয়।
অভিযোগ, পুলিশ প্রথম দিকে ফিরেও তাকায়নি। পরে যে কোনও কারণেই হোক, হঠাৎ তাদের তৎপরতা বাড়ে। প্রশাসনের উপরতলা থেকেও সাংবাদিকদের উপর হামলার তীব্র নিন্দা করা হয়।
মনে পড়ে, কয়েক মাস আগেই একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির খবর সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকদের প্রেস ক্লাবের সামনে ফেলে মেরেছিল পুলিশ। কী ‘অপরাধ’ ছিল, তা অস্পষ্ট। তবে বুধবার সাংবাদিক-নিগ্রহের পরে প্রশাসন যে-ভাবে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে এবং হিন্দু সংহতির প্রধান তপন ঘোষকে গ্রেফতার করেছে, তাকে সাধুবাদ দিতেই হয়।
এটাই তো কাম্য। কারণ লাঠির রং সবুজ হোক বা গেরুয়া, রক্তের রং সব সময়ই লাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy