Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
তিন তালাক থেকে প্রাইভেসি, সব প্রশ্নেই নাকি বিজেপির জয় হল!

জিতলেও জয়ী, হারলেও

ধরা যাক, তিন তালাক সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়টি। এক ধাক্কায় তিন বার তালাক বলে (বা লিখে) বিবাহিত স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার অবিশ্বাস্য রকম পশ্চাৎপদ প্রথাটি রদ হল। অমনি চার দিকে নাচানাচি, ‘দেখো দেখো, নরেন্দ্র মোদীই পারলেন, এ দেশে কেউ কোনও দিন পারেনি!’ এ নাকি বিজেপিরই দীর্ঘ লড়াইয়ের সাফল্য। তারাই নাকি মুসলিম নারীর অধিকারের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে সংগ্রাম করছিল।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

কো নও কোনও মানুষ সব সময়ে সব বিষয়ে নিজেদের পরাজিত কিংবা আক্রান্ত মনে করেন। এই অসুখের একটা নামও আছে, ভিকটিম কমপ্লেক্স। আচ্ছা, একটা উল্টো অসুখ থাকতে পারে না? যিনি সব বিষয়ে সব পরিস্থিতিতে নিজেদের বিজয়ী মনে করেন? সেটার নাম কী হতে পারে? উইনার কমপ্লেক্স? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে ক’দিন ধরে, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের দেখে। অদ্ভুত ক্ষমতা এঁদের। যা-ই ঘটুক না কেন, তাঁরা বুক বাজিয়ে চেঁচান: আমাদের জয়, আমাদের জয়!

ধরা যাক, তিন তালাক সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়টি। এক ধাক্কায় তিন বার তালাক বলে (বা লিখে) বিবাহিত স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার অবিশ্বাস্য রকম পশ্চাৎপদ প্রথাটি রদ হল। অমনি চার দিকে নাচানাচি, ‘দেখো দেখো, নরেন্দ্র মোদীই পারলেন, এ দেশে কেউ কোনও দিন পারেনি!’ এ নাকি বিজেপিরই দীর্ঘ লড়াইয়ের সাফল্য। তারাই নাকি মুসলিম নারীর অধিকারের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে সংগ্রাম করছিল। দেখেশুনে স্তম্ভিত বনতে হয়।

সুপ্রিম কোর্টের রায়, সংসদে বিল পাশ নয়— তবু কৃতিত্বটা বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর! সর্বোচ্চ আদালতে মামলা ঠুকলেন মুসলিম মহিলারা, নির্লজ্জ পুরুষতান্ত্রিক মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের বিরোধিতায় নামলেন, সর্বোচ্চ আদালতে একটানা শুনানি চলল, আর সব ছাপিয়ে সব আলো তার কেমন করে গিয়ে পড়ল ‘মোদীজি’র ওপর?

মনে আছে, মোদীর দল ঠিক কী বলেছিল এ বিষয়ে? বলেছিল, তিন তালাক রদ হওয়া উচিত, কেননা এই প্রথা বুঝিয়ে দেয় শরিয়তি আইন কত আপত্তিকর, ভারতের মুসলিম সমাজকে সোজাসুজি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ তিন তালাক-বিরোধিতার মধ্য দিয়ে ইসলামি আইনবিধিটাকে রদ করার কথা বলছিলেন তাঁরা। তা হলে কি বলা যায় যে, এই রায় বিজেপির জয়? এ তো তাঁদের চূড়ান্ত পরাজয়! ক’দিন আগেকার উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি (‘আদালত কিন্তু রাষ্ট্রের যুক্তি চাপিয়ে দিতে বারণ করছে’, অমিতাভ গুপ্ত, ২৪-৮) মনে করতে পারি: তিন তালাক মামলায় বিজেপির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর পরিবর্তন/সংশোধন/বাতিল নিয়ে এক পা-ও এগোনো যায়নি। ওই রায়ে বরং পরিষ্কার বলা হয়েছে, কোনও ধর্ম-সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিধিবিধানে ভারতীয় রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না। তালাক-ই-বিদ্দত বা এক বাক্যে তিন তালাক প্রথা ‘শরিয়তি বিধানে নেই’ বলেই আদালত সেখানে হাত দিচ্ছে। প্রধান বিচারপতি খেহর যে বিরুদ্ধ যুক্তি দিলেন, সেটাকে তো বলা যায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পথে এ-যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় আইনি বাধা। এই রায়ের পর নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহদের দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ার কথা। কিন্তু না, পরাজয় মেনে নেওয়া অসম্ভব, যা-ই হোক না কেন, তাঁদেরই জয়! সুতরাং উল্টো ঢাক বেজে উঠল: ‘আমাদের জয়’, ‘আমাদের জয়’।

এখানেই শেষ নয়। দুই দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় বিপ্লব: রাইট টু প্রাইভেসি বা ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের স্বীকৃতি। কিমাশ্চর্যম্, এতেও শুনলাম বিজেপি-র ঢক্কানিনাদ! অথচ এত বড় ধাক্কা মোদী সরকারের কপালে আগে ঘটেনি! নয় জন বিচারকের সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হওয়া স্বাধীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রায়টিতে বিজেপি সরকারের সরাসরি মুখ পুড়েছে। মোদী মুখ বন্ধ রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু বাবুর পারিষদরা তো আছেনই। অমিত শাহ ব্লগে লিখলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে তাঁরা আপ্লুতচিত্ত! রবিশংকর প্রসাদ বক্তব্য পেশ করলেন, তাঁদের সরকারই এই দাবি অ্যাদ্দিন ধরে করে এসেছে! অরুণ জেটলির একটি পুরনো বাক্যকে খুঁজে পেতে বার করে প্রমাণ হিসেবে পেশ করলেন তিনি, যেখানে জেটলি বেশ দ্বিধাসহকারে উচ্চারণ করেছিলেন যে রাইট টু প্রাইভেসি ‘অ্যাবসোলিউট’ বা ‘চরম’ অধিকার না হলেও মৌলিক অধিকার ‘হলেও হতে পারে’!

জেটলির কথা রবিশংকর প্রসাদের স্মরণপথে উদিত হল, কিন্তু সরকার পক্ষের অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগির বাক্যটি তিনি নিপাট ভুলে গেলেন যে, ‘রাইট টু প্রাইভেসি’ কোনও মৌলিক অধিকার হতেই পারে না! তিনি এক বারও বললেন না যে, পাঁচটি বিজেপি-শাসিত রাজ্য, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, হরিয়ানা, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, সকলেই সরকারি পক্ষের সমর্থনে আদালতে আইনি প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। সওয়া তিন বছরের শাসনে একের পর এক ক্ষেত্রে নাগরিকের ব্যক্তিপরিসর অমান্য করাকে সরকারি সমর্থন জোগানো হয়েছিল: আধার, গোমাংস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আন্তঃধর্ম বিবাহ, সমলিঙ্গ সম্পর্ক! সংসদে ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের আনা বিল বিজেপির উদ্যোগে হারানো হয়েছিল। ‘প্রাইভেসি’ তখন রসিকতার বিষয়, এমনকী সংসদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনাও করতে দেয়নি সরকার। রাজনীতি মানে মিথ্যেরই রাজপাট, এটা জানা, তবু এত বড় অসত্যভাষণ, এতটা অসততা দিয়ে ভোটারদের ভুল বোঝানো? স্বাধীন ভারত বেশি দেখেনি এমন!

জেটলির ওই বক্তব্যটি ছিল আধার প্রসঙ্গে। আধারে যে ভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছিল, তাতে ব্যক্তিপরিসর ক্ষুণ্ণ হতে পারে: এই অভিযোগের উত্তরে জেটলি বলেছিলেন, ব্যক্তিপরিসর কোনও চরম অধিকার নয়, প্রয়োজনে তা বিলক্ষণ সংকুচিত করা যায়। অর্থাৎ ব্যক্তিপরিসর মৌলিক অধিকার হোক না হোক, বিজেপি মন্ত্রিবর্গ সেটা সংকোচনের পক্ষেই যুক্তি দিয়েছিলেন। অথচ এখন দিন বেমালুম রাতে পর্যবসিত, কংগ্রেসই নাকি গোলমাল পাকিয়েছিল, আধার তৈরির সময় তারাই নাকি প্রাইভেসির বিষয়টা খেয়াল রাখেনি। কথাটা যে কতটা মিথ্যে, সেটা আর একটু না বললেই নয়। ইউপিএ সরকারের আমলে এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে আধার তৈরি করার উদ্দেশ্যটা ছিল সীমিত: সরকারি ভরতুকির ডিস্ট্রিবিউশন। কিন্তু আধারকে এ ভাবে আইনগত ভাবে নাগরিকের আবশ্যিক পরিচিতি করে তোলা, আয়কর জমা থেকে সৎকারকার্য, সব বিষয়ে সেটাকে প্রধান প্রমাণপত্র হিসেবে কার্যকর করা, এগুলো কিন্তু বর্তমান সরকারের মাথা থেকেই বেরিয়েছে। আধারকে করে তোলা হয়েছে ব্যক্তিপরিসরে ঢোকার জন্য রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুবিধেজনক চোরাপথ। তাই, আধারের তথ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা কতখানি পোক্ত, সেই প্রশ্ন বর্তমান সরকারের আমলেই গুরুতর হয়েছে, আগের সরকারের আমলে হয়নি। অর্থাৎ ব্যক্তিঅধিকারের পরিসর সংকুচিত করার পক্ষে এই সরকারই লড়েছে, আগের সরকার নয়।

সবশেষে, ডেরা সচ্চা সওদা। যত দোষ নাকি মুখ্যমন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রীজির সরকার তাঁকে কত ভর্ৎসনা করছেন। অথচ প্রথম জন যে দ্বিতীয় জনের পরামর্শ ও সমর্থন ব্যতীত এক পা-ও চলতে পারেন না, গোটা দেশ জানে। স্বচ্ছ ভারতের পথপ্রদর্শক হিসেবে রাম রহিমের প্রতি মোদী ভক্তিশ্রদ্ধায় নিমজ্জিত, সেটাও জানা। তবু মোদীমশাই এখন স্বচ্ছ, নিষ্পাপ, তাঁর সরকার দেশে শান্তি ও স্থিতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ, দুর্নীতি দুরাচারের ঘোর শত্রু। শুধু ওই পাজি রাজ্য সরকারটারই যত অপদার্থতা!

এই যে প্রতিটি পরাজয়কেই উল্টে এবং পাল্টে দিয়ে নিজের জয় হিসেবে দেখানো, এটাই বর্তমান সরকারের বৈশিষ্ট্য। কোনও কিছুই সে ছাড়ে না, সবটাই নিজের মধ্যে গিলে ফেলতে চায়। কোর্টের রায় সরকারি অবস্থানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে? গিলে নাও সেটাকে! অন্যরা আদালতে জিতে যাচ্ছে? দাও সেটাকে ‘নিজের’ বলে দাগিয়ে! মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে করতেই তাদের মসিহা বলে স্বীকৃতি চাও। ব্যক্তিপরিসরের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তেই মানুষকে বোঝাও তুমিই ব্যক্তিপরিসরের উদ্গাতা। দলিতদের উপর চড়াও হতে হতেই দলিত নেতা অম্বেডকরের পূজারি হয়ে যাও। আরএসএস-এর পদলেহন করতে করতেই ‘গাঁধীর চরকা আমারই চরকা’ ছবি দেশের হৃদয়ে গেঁথে দাও।

এই সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলা যায় কি না, তা নিয়ে পণ্ডিতরা তর্কবিতর্ক করুন। আমরা কেবল জানি, সামান্য পরিসরও অন্যদের জন্য না ছেড়ে কথায় কথায় এই ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন’ বা গিলে ফেলার প্রয়াস, এটাই ফ্যাসিবাদের চিহ্ন। কে জানে, কোন দিন দেখব, গোমাংস খাওয়াকে সমর্থন করছে দেশের আদালত, আর ফ্যাসীয় মোদীবাদ হাত-পা তুলে লাফাচ্ছে: আরে, এ তো আমারই কথা, আমারই জয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE