গত দুইটি সপ্তাহ কি ভারতীয় রাজনীতিতে কোনও স্থায়ী দাগ রাখিয়া যাইবে? প্রশ্নটি অনেকের মনেই ঘুরপাক খাইতেছে, সঙ্গোপনে। রাহুল গাঁধী গত দুই সপ্তাহ এমন একটি কাজ করিয়াছেন যে তাহার ফল সুদূরপ্রসারী হইবার কিছু সম্ভাবনা তাঁহারা আশা করিতেছেন। পনেরো দিন লাগাতার মার্কিন দেশের পশ্চিম হইতে পূর্ব উপকূল ঘুরিয়া বেড়াইলেন রাহুল, গুরুত্বপূর্ণ গণস্থানে ও প্রতিষ্ঠানে দৃপ্ত কণ্ঠে দাপুটে ভাষায় বর্তমান ভারতীয় সরকারের তীব্র সমালোচনা করিলেন। তীব্র, কিন্তু সংহত ও সুবিবেচিত। বাস্তবিক, নরেন্দ্র মোদীর প্রতিপক্ষ হিসাবে স্বঘোষিত বিরোধী নেতা রাহুল গাঁধী গত তিন বৎসরের মধ্যে মোদীর সর্বাপেক্ষা গুরুতর সমালোচনার তরঙ্গটি এই বারই তুলিতে পারিলেন, অথচ তাহা করিতে গিয়া এক বারের জন্যও শালীনতা বা শোভনতার সীমা অতিক্রম করিলেন না। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়্যার, সর্বত্রই রাহুল গাঁধীকে কৌতূহলী রাজনীতি-পক্ব জনতা ঘিরিয়া ধরিয়াছেন, মোদীর রাজত্বে ভারতের সামাজিক পরিবর্তন বিষয়ে ব্যগ্র প্রশ্নে তাঁহাকে জেরবার করিয়াছেন, এবং রাহুল বিচক্ষণ দক্ষতায় সে সকল প্রশ্ন সামলাইয়াছেন। বিজেপি কী ভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রের মান ‘অবনমিত’ করিতেছে, মোদী ও তাঁহার সরকার কী ভাবে দেশময় ‘অসহিষ্ণুতা’র সংস্কৃতি প্রচার ও প্রসার করিতেছেন, রাহুলের বক্তব্য শুনিয়া বিদেশি শ্রোতৃমণ্ডলী উৎকণ্ঠিত না হইয়া পারেন নাই।
নেতা হিসাবে ইহা রাহুল গাঁধীর পক্ষে একটি বড় পালক, অনেক সময়ই রাজনৈতিক নেতারা এ ভাবে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে পালক পাইয়া যান। কিন্তু রাহুল গাঁধীর ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়েও বড় ঘটনা, ভারত বিষয়ে এখনকার আন্তর্জাতিক মনোভাব। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাহুল যাহা বলিয়াছেন, ঠিক তাহাই শ্রোতৃবৃন্দ শুনিতে চাহিয়াছিলেন। ভারতীয় সমাজের দ্রুতপ্রসারী অসহিষ্ণুতা গোটা বিশ্বকে কতখানি উদ্বিগ্ন করিয়া রাখিয়াছে, তাহার অব্যর্থ প্রমাণ রাহুল গাধীর সফর। বিজেপি আপত্তি তুলিয়াছে, বিদেশের মাটিতে গিয়া দেশের সমালোচনা কি আদৌ নেতৃসুলভ আচরণ? আপত্তিটির প্রেক্ষিতে একটি কথাই বলিবার। দেশ এবং দেশের সরকারের মধ্যে পার্থক্য আছে, এবং কখনও কখনও সেই পার্থক্য বেশ বড় রকমের। সরকারের সমালোচনা করিলে তাহা দেশের সমালোচনা হইয়া যায় না, বরং দেশকে কোন বিকল্প পথে নেতৃত্ব দেওয়া যায়, তাহার ভাবনা হিসাবেও এই সমালোচনা জরুরি। দেশের প্রতি দায়িত্ববশতই কোনও রাজনৈতিক নেতা বিদেশে গিয়া সরকারের অকুণ্ঠ সমালোচনা করিতে পারেন।
আরও একটি কথা আছে। এই নূতন বিশ্বায়িত, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দুনিয়ায় ঘর আর বাহিরের তফাত বলিতে কি কিছু আর অবশিষ্ট আছে? বিদেশের মাটিতে না গিয়াও ওয়েবসাইটে ফেসবুকে টুইটারে বিদেশি জনসমাজের কাছে নিজের বার্তা এখন মুহূর্তে পৌঁছাইয়া দেওয়া সম্ভব। সুতরাং এই সব অকারণ অর্থহীন ছুঁতমার্গ একবিংশ শতকে শোভা পায় না। বরং ভাবিবার বিষয়, দেশ ও বিদেশ, বিদেশে দেশীয় সমাজ অর্থাৎ ডায়াস্পোরা, সব মিলাইয়া জগৎ এখন কতটাই সীমান্তহীন যে রাজনৈতিক নেতার নিজেদের রাজনীতির বড় পদক্ষেপটিও অবস্থাবিশেষে বিদেশের মাটিতেই লওয়া সমীচীন বোধ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষা প্রধান বিরোধী দলের উপ-সভাপতি অনেক কম বিদেশ সফর করেন। কিন্তু এক দিক দিয়া প্রধানমন্ত্রীর সহিত তিনি এই বার একাসনে বসিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে নিজের প্রচারকে যেমন ভাবে নিজের ঘরোয়া রাজনীতির আবশ্যিক অংশ করিয়া তুলিয়াছেন, রাহুল গাঁধীও কিয়দংশে তাহা করিতে পারিলেন। এই কৃতিত্ব প্রশংসার্হ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy