Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

তাড়নার সংকট

দুর্ভাগ্যজনক। কেবল গোর্খাল্যান্ড সংকট নয়, গোটা পরিস্থিতির মধ্যেই এক রকমের বিকার লক্ষণীয়। বিচারবিভাগ যাহা করিতেছে, অবশ্যই তাহা সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত— এই মুহূর্তে যৎসামান্য যাহা আশার আলো, সেখান হইতেই মিলিতেছে। কিন্তু এই সক্রিয়তা কি সত্যই কাঙ্ক্ষিত ছিল?

‘গোর্খাল্যান্ড’ নিয়ে বিক্ষোভ কালিম্পঙে। ছবি: পিটিআই।

‘গোর্খাল্যান্ড’ নিয়ে বিক্ষোভ কালিম্পঙে। ছবি: পিটিআই।

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

চ রম অচলাবস্থা কাটিবার কোনও লক্ষণ নাই, তাই বিচারবিভাগের আবারও উদ্বিগ্ন নির্দেশ, পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা ফিরাইতেই হইবে। বিচারবিভাগের দুই স্তর আলাদা করিয়া কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার, উভয়ের প্রতি এই নির্দেশ জারি করিয়াছে। কলিকাতা হাইকোর্ট বলিতেছে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের চাহিদানুযায়ী আরও আধাসেনা পাঠাক, নতুবা অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। আর সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছে রাজ্য সরকার যথা শীঘ্র সম্ভব যানচলাচল ও জীবনযাপন স্বাভাবিক করুক। একই সঙ্গে বিচারবিভাগের দুইটি শীর্ষস্থানীয় আদালতে একই বিষয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের চাপান-উতোর এবং ফলস্বরূপ দুই আদালতের নির্দেশ জারি— এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। বিচারবিভাগের প্রবল সক্রিয়তাই বলিয়া দেয় পরিস্থিতি কতখানি উদ্বেগজনক। পাহাড়ি মানুষ খাদ্যাভাবের শিকার, স্কুলকলেজ বন্ধ থাকায় পড়াশোনা ও পরীক্ষায় অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতিতে জীবনযাপনের অনিরাপত্তা, নৈরাজ্য ও সংঘর্ষ এমন মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে, যেখান হইতে উত্তেজনার পারদ নামানোই মুশকিল। আন্দোলনের আগুন লইয়া খেলিবার ইহাই বিপদ। ইচ্ছামতো ফুলকি ছড়াইতে ছড়াইতে হঠাৎ এমন দাউদাউ জ্বলিয়া যায় যে তখন আর তাহাকে ইচ্ছামতো নিবানো যায় না। গোর্খাল্যান্ড নেতাদেরও তাহাই হইয়াছে। রাজ্য সরকারের হাতে তো আগুন নিবাইবার উপকরণগুলিই নাই, পুলিশ দিয়া নিয়ন্ত্রণ করিতে গেলে উলটা ফল ফলিবার সম্ভাবনা। আর কেন্দ্রীয় সরকার যে ঠিক কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ, আন্দোলনের পক্ষে না বিপক্ষে, তাহাই পরিষ্কার নয়। হাতে থাকে কেবল আদালতের তাড়না।

দুর্ভাগ্যজনক। কেবল গোর্খাল্যান্ড সংকট নয়, গোটা পরিস্থিতির মধ্যেই এক রকমের বিকার লক্ষণীয়। বিচারবিভাগ যাহা করিতেছে, অবশ্যই তাহা সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত— এই মুহূর্তে যৎসামান্য যাহা আশার আলো, সেখান হইতেই মিলিতেছে। কিন্তু এই সক্রিয়তা কি সত্যই কাঙ্ক্ষিত ছিল? শাসনবিভাগের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কারণেই কি আদালতকে বিষয়টিতে অকারণে এতখানি জড়াইতে হইল না? কেন্দ্র-রাজ্যের রাজনীতির দ্বৈরথ, দুই পক্ষের পারস্পরিক অসহযোগিতা এই স্তরে না উঠাইয়া কি বিষয়টির মীমাংসার চেষ্টা সম্ভব ছিল না? ইহা দুর্ভাগ্য, এবং দুই সরকারকেই দুর্ভাগ্যের দায়িত্ব স্বীকার করিতে হইবে। দলীয় রাজনীতির সংঘর্ষ থাকিবেই, কিন্তু তাহাকে এই ভাবে মানবজীবন পঙ্গু করিবার স্তরে উঠিতে দেওয়া অত্যন্ত অন্যায়। শাসনবিভাগের কাজে বিচারবিভাগ হস্তক্ষেপ করিবে না, এমনই তো জানা আছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রাখিতে গেলে বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে দূরত্বও রাখা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এখন এতই করুণ যে কেন্দ্র কত আধাসেনা পাঠাইবে, কিংবা রাজ্য কতখানি দৃঢ়তায় আইন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করিবে, ইত্যাকার নির্দেশও আদালতের মুখ হইতে শুনিতে হইতেছে।

সুস্থ সাংবিধানিক কাঠামো অনুযায়ী কী ভাবে সংকটের অবসান সম্ভব, ভাবিতে হইবে। পাহাড়ি অচলাবস্থার সমাধানের অপেক্ষা এই সংকটের সমাধান কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। ভারতীয় গণতন্ত্রের মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য দায়দায়িত্বের ভাগাভাগিটি রাখিয়াও সহযোগিতা যেমন জরুরি, তিন বিভাগের কাজের মধ্যে সংযোগ রাখিবার সঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা ততটাই প্রয়োজনীয়। আদালত ইতিপূর্বেও বার্তা দিয়াছে। সেই বার্তা উপর্যুপরি লঙ্ঘিত হইতেছে। আবারও হয়তো হইবে। ইহাতে কি বিচারবিভাগের গুরুত্বের হানিও ঘটিতেছে না? এই ভাবে চলিতে থাকিলে, শঙ্কা হয়, আদালত যাহা বলিবার বলিয়া যাইবে, অন্যেরা যাহা করিবার তাহা করিয়া যাইবে, আদালতের নির্দেশের কোনও মান্যতা থাকিবে না। এই শঙ্কাকে অমূলক বলিবার কোনও উপায় নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gorkhaland Protest Morcha Darjeeling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE