দেশের স্বাধীনতার কালে আমার বয়স চার। সেই বয়সেই প্রাথমিক স্কুলে। ধরমপুর, সিজুয়া, নয়াবসান— তিন গ্রাম মিলে একটাই স্কুল, অথচ ছাত্রসংখ্যা সামান্য। ছাত্রী তো ছিলই না। ছাত্ররা ছিল হয় উৎকলি ব্রাহ্মণ, বা খণ্ডায়েত ও তেলিদের মতো মধ্যজাতির, যাদের জীবিকা ছিল প্রধানত নিজের জমিতে চাষ। গ্রামগুলোতে প্রচুর সংখ্যায় বাগদির বাস। নিম্নবর্ণ, তফসিলভুক্ত, ভূমিহীন এই জাতির লোকেদের পেশা দিনমজুরি। যাঁরা মজুর নিয়োগ করতেন, তাঁদের বলা হত ‘গিরহিয়া’ (গৃহস্থ)। কিন্তু মজুরদের গৃহস্থালি এতই তুচ্ছ যে সেটা ভাষায় স্থান পায়নি। তাঁদের পুরুষরা ‘মুলিয়া’, যাঁরা ‘মুল’ (কাজের মূল্য) পান, আর মেয়েরা ‘কামুন/কামনি’। এঁদের সন্ততিরা ‘গিরহিয়া’ বাড়িতে গরু-ছাগল চরানোর কাজে লেগে যেত, ইস্কুলে যাওয়াটা ছিল স্বপ্নেরও বাইরে। শ্রেণি-জাতি কাঠামোয় নিম্নবর্ণের লোকেদের শিক্ষা, সম্পত্তি বা কথা বলার অধিকার ছিল না। রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল ব্রাহ্মণ ও মধ্যজাতির লোকেদের হাতে।
১৯৫২। স্বাধীন ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একটি করে ভোট। আর ভোটের দায়ে, সেই প্রথম রাজনীতির লোকেরা বাগদি পাড়ায় ঢুকল। না, এখন যেমন নেতারা করজোড়ে ভোট চাইতে যান, ঠিক তেমন নয়। সুরটা হুকুমেরই, তবু বাগদি সন্নিকটে ব্রাহ্মণের আগমনের ভেতর দিয়ে একটা নতুন ব্যবস্থার সূচনা হল। তার পর গত ৬৬ বছরে সুবর্ণরেখা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ১৯৬৯, নকশালবাড়ির প্রেরণায় ফসল কাটার অভ্যুত্থান, ১৯৭৭ পরবর্তী মজুরি আন্দোলন, জমি দখল, অপারেশন বর্গা। এ সহস্রাব্দে এসে মিড-ডে মিল, ১০০ দিনের কাজ, বন অধিকার আইন, খাদ্য সুরক্ষা আইন। এ সবের ভেতর দিয়ে বাগদি পাড়াতেও মস্ত পরিবর্তন, এখন বালক-বালিকা নির্বিশেষে সব শিশু ইস্কুলে যেতে পারে। শিক্ষার মান বেশ নিচু হলেও অনেকেই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোচ্ছে। ‘মুলিয়া’ হওয়া ছিল যাদের বিধিলিপি, তাদের কেউ কেউ প্রাথমিক শিক্ষকতা বা অন্য ধরনের চাকরিবাকরিও জোগাড় করতে পেরেছে। তাদের বেশির ভাগই অল্পসল্প জমির মালিক।
যদিও বাগদিরা এখনও সর্ব ক্ষেত্রে ঘোর অসাম্যের শিকার, এখনও তাঁদের বেশির ভাগকেই বেঁচে থাকতে হয় কঠোর দেহশ্রমের উপর ভর করে, ছয় দশক আগের তুলনায় অগ্রগতিগুলোকেও উপেক্ষা করা চলে না। আর এই অগ্রগতিগুলোতে এক দিকে যেমন ভূমিকা আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের, তেমনই আবার দেশজুড়ে গণ-পরিসরের আলোচনা ও বিতর্কেরও একটা মস্ত প্রভাব আছে। বস্তুত, দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতিকে প্রভাবিত করার কাজে সকলের, বিশেষত বিদ্যাবেত্তাদেরও একটা বড় কর্তব্য আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বিদ্যাচর্চার জগতে এমন লোক কম। আমাদের সৌভাগ্য, কম হলেও এমন লোকও আছেন, যিনি বিতর্ক-আলোচনা গড়ে তোলার জন্য যেমন অক্লান্ত ভাবে জ্ঞান অর্জন করে চলেন, সেগুলো নিয়ে সমানে লিখে যান, আবার নিজেও আন্দোলনে যোগ দেন। জঁ দ্রেজ এমনই এক জন লোক, যিনি গবেষণা সংগঠিত করেন ‘কাজের জন্য’, আবার বাস্তব ‘কাজ’গুলোর সংগঠনেও যোগ দেন। শিক্ষাঙ্গনের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে না থেকে তিনি ঘুরে বেড়ান দেশের দরিদ্রতম এলাকাগুলোতে, ‘বিনা বেতনে গাধার খাটনি’ খাটার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করে তাদের নিয়ে যান গ্রামে-বস্তিতে মানুষের জীবনযাপনের ছবি তুলে আনতে, আবার সমীক্ষালব্ধ সেই তথ্য নিয়ে জন-শুনানির আয়োজন করতে। তিনি আদ্যন্ত গবেষক, আবার ষোলো আনা গণ-কর্মী।
এই দুই সত্তার মধ্যে যে কোনও বিরোধ নেই, বরং এরা পরস্পরের পরিপূরক তার নমুনা আমরা দেখেছি খাদ্য সুরক্ষা থেকে নিয়ে শিশু অধিকার পর্যন্ত নানা বুনিয়াদি ব্যাপারে জঁ দ্রেজ-এর বিভিন্ন ‘কাজের জন্য গবেষণা’ নির্ভর লেখাপত্রে, যেগুলোর উদ্দেশ্য দেশের সামাজিক নীতিকে প্রভাবিত করা। তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি ও কাণ্ডজ্ঞান’ এ রকমই বিভিন্ন লেখার সংকলন।
এমন ভাবার কারণ নেই যে, ‘কাজের জন্য গবেষণা’, সরকারি নীতিতে সেগুলোর প্রতিফলন, আন্দোলন ও গবেষণার মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক-আর্থনীতিক কাঠামোটাই বদলে ফেলা যাবে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, এগুলোর ভেতর দিয়ে আমরা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারি। উদাহরণ হিসাবে জঁ দেখেছেন, কী ভাবে উচ্চবর্ণের লোকেরা স্কুলে মিড-ডে মিলের বিরোধিতা করে, কী ভাবে মধ্যপ্রদেশের হিন্দুত্ববাদী সরকার মিড-ডে মিলে ডিম দেওয়ার বিরোধিতা করে, কী ভাবে সরকারি কর্তা ও কর্পোরেট পুঁজির যোগসাজসে গড়ে ওঠে দুর্নীতি। আবার, কী ভাবে গণ-আলোচনা ও বিতর্কের সাহায্যে সরকারি নীতিকেও এ সব বাধা সরানোর কাজে লাগানো যায়।
গণ-পরিসরে আলোচনা ও বিতর্কের প্রভাব পড়েছিল ২০০৪-২০১৪ পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের নীতিতে। শিক্ষার অধিকার, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, তথ্যের অধিকার, খাদ্য সুরক্ষা, বন অধিকার, ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আইন পাশ হল। দেখা গেল, সামান্য তৎপরতা দেখিয়েই কিন্তু সামাজিক-আর্থনীতিক ভাবে একেবারে পিছিয়ে থাকা রাজ্যও তার জনসাধারণের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বদল আনতে পারে। যেমন মিড-ডে মিল। এটা শুধু বাচ্চাদের খিদে পেটে স্কুলে যাওয়া আটকানোতেই নয়, আরও বিরাট ভূমিকা পালন করল, জাতি-ব্যবস্থার উপর আঘাত হানার মধ্য দিয়ে, উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের শিশুরা এক সঙ্গে খাবার খেতে লাগল। ভারতে জাতিব্যবস্থা মূলত হিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত একটা ব্যবস্থা, যার বলে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী উচ্চবর্ণের লোকেরা সামাজিক উৎপন্নের প্রায় পুরোটাই আত্মসাৎ করে এসেছে, আর বাগদিদের মতো নিম্নবর্ণ, আদিবাসী বা মুসলমানরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও পেট ভরানোর মতো খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। খাদ্য সুরক্ষা আইনও এক বিরাট পদক্ষেপ। কর্মসংস্থান আইন, বা বন আইনও তেমনই মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির পথে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। ইউপিএ সরকার বা সমস্ত রাজ্য সরকার যে এই সব আইন বা অধিকার রূপায়ণে একই রকম গুরুত্ব দিয়েছে, তা নয়। কেরল, তামিলনাডু, হিমাচলপ্রদেশ অনেক এগিয়ে, তারা শুরুও করেছে অনেক আগে; আবার ওডিশার মতো রাজ্য পরে শুরু করেও প্রমাণ করেছে যে, মানুষের জীবনমানের উন্নতিতে কাজ করা সম্ভব।
এই আংশিক অগ্রগতি, স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ২০১৪-র পর বিপদের সম্মুখীন। মিড-ডে মিল, আইসিডিএস, কর্মনিশ্চয়তার মতো প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ কমছে, আবার আইনগত ভাবে পাওয়া অধিকারগুলোও সঙ্কুচিত করা হচ্ছে আধার-এর মতো আক্রমণের মধ্য দিয়ে। আমরা এক রাজত্বে বাস করছি যেখানে দীর্ঘ ছয় দশকের সংগ্রামে গণতন্ত্রের যেটুকু পরিসর গড়ে তোলা গিয়েছে তার পুরোটাকেই অবলুপ্ত করে দেওয়ার চেষ্টা। এই অন্ধকার ক্ষণে কাণ্ডজ্ঞানের অনুশীলন একান্ত জরুরি। হয়তো বা একমাত্র পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy