Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বর্জ্যভূমি বহুমূল্য সম্পদ, বুঝিয়েছিলেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ

তাঁর কথা না শুনলে খেসারত দিতে হবে

এমন এক বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে ১৬ ডিসেম্বর চলে গেলেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। আদতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, সত্তরের দশকে তিনি পিএইচ ডি গবেষণার অভিনব বিষয় বাছলেন— পুব-কলকাতার জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল ও আর্থিক উপকারিতা।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

গবেষকমাত্রের স্বপ্ন, জ্ঞানচর্চার একেবারে নতুন একটা ক্ষেত্র আবিষ্কার করা। এমন সৌভাগ্য হয় কোটিতে এক জনের। তার পিছনে থাকে কিছুটা কপালজোর, ঢের বেশি অনুপাতে চিন্তার প্রস্তুতি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। দুনিয়ায় একেবারে নতুন জিনিস কমই আছে: কলম্বাস তো আমেরিকা ‘আবিষ্কার’ করেননি, আগে থেকেই সেখানে বহু মানুষ বসবাস করত, একাধিক প্রাগ্রসর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সব গোড়ারও একটা গোড়া আছে। সেটা চিনতে পারা, তার নিহিত সম্ভাবনা ফুটিয়ে তুলে প্রতিষ্ঠিত করাতেই গবেষকের প্রতিভার প্রকাশ।

এমন এক বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে ১৬ ডিসেম্বর চলে গেলেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। আদতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, সত্তরের দশকে তিনি পিএইচ ডি গবেষণার অভিনব বিষয় বাছলেনপুব-কলকাতার জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল ও আর্থিক উপকারিতা। এ নিয়ে কিছু কাজ অবশ্যই আগে হয়েছিল; কিন্তু ওই সময়টায় আধুনিক পরিবেশচিন্তা সবে গড়ে উঠছে, এই গবেষণার মাধ্যমে তার পুরোভাগে উঠে এলেন ধ্রুবজ্যোতি; ক্রমে লাভ করলেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি, ১৯৯০-এ রাষ্ট্রপুঞ্জেরগ্লোবাল ৫০০সম্মান থেকে ২০১৬-য় লুক হফমান পুরস্কার অবধি বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আরও বড় কথা, আজীবন দায়িত্ব কাঁধে নিলেন মানুষকে, বিশেষত তাঁর দেশবাসী আর শহরবাসীকে বোঝাতে যে জলাভূমি আর পতিত ভূমি, ওয়েটল্যান্ড আর ওয়েস্টল্যান্ড, আমাদের বহুমূল্য সম্পদ, যা লালন করলে আমাদের সুখ-সমৃদ্ধি, ধ্বংস করলে জবাই হবে সোনার ডিম-পাড়া হাঁস।

তাঁর একটা বিরাট সুবিধা অবশ্যই ছিল: ঘরের পাশে পুব-কলকাতায় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নগরসংলগ্ন জলাভূমি। জলাভূমির সঙ্গে মানুষের নিবিড় সহাবস্থান, সেখানকার আর্থিক উন্নয়ন আর সামাজিক কল্যাণের সম্ভাবনা বোঝার এমন পাঠশালা আর নেই। প্রায় তাঁর একক প্রচেষ্টাতেই এটি সংরক্ষিত অঞ্চল বলে ঘোষিত হল, চূড়ান্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল রামসার সংগঠনের বিচারে পৃথিবীর এক অগ্রগণ্য জলাভূমি হিসাবে। এই সব সাফল্যের পিছনে ছিল তাঁর জীবনভর চিন্তা ও কর্মপ্রয়াসে সাধিত, বিজ্ঞানের একাধিক শাখার সঙ্গে অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের মিলনে এক অভিনব চর্চাক্ষেত্র। আর এক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথন এই বহুমুখী চর্চার নাম দিয়েছেনকল্যাণমুখী পরিবেশবিদ্যা’, ওয়েলফেয়ার ইকলজি; তার হোতার ভূমিকায় বসিয়েছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষকে।

ধ্রুবজ্যোতির কাজের ব্যবহারিক দিকটা প্রাধান্য পায় বলেই বেশি করে বলতে হয়, তাঁর কর্মকাণ্ডের মূলে আছে মেধা ও চিন্তার অসামান্য অভিজ্ঞান। তিনি ছিলেন দার্শনিক, সদর্থে ইন্টেলেকচুয়াল। বঙ্গীয় মননশীলতার যে অ-তাত্ত্বিক ও অ-রাজনৈতিক দিকগুলি চিরকাল উপেক্ষিত থেকে গেল, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চাও যা প্রায়শ এড়িয়ে চলে, সেই ধারার এক নতুন অভিব্যক্তির তিনি প্রবর্তক। মিশেল ফুকো শুনলে ব্যাপারটা বুঝতেন, যদিও তাঁর অনুসারী বায়বীয় তাত্ত্বিকরা তা ধর্তব্যে আনেন না।

এই মননের একটা দিক বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। আগেই বলেছি, জনজীবনে জলাভূমির এই ভূমিকা ধ্রুবজ্যোতি অভিব্যক্ত করেছেন, সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টি করেছেন জনজীবনেরই শরিক, পুব-কলকাতার এক-দেড়শো বছর আগের প্রান্তিক অধিবাসীরা। আমাদের দেশে জ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ধারাগুলি সাধারণ্যের প্রচলন ও উদ্ভাবন থেকে উঠে এসেছে, তা চিরকালই উপেক্ষিতকী সাবেক ব্রাহ্মণ্যবাদের দৃষ্টিতে, কী আধুনিক উচ্চবর্গীয় বিজ্ঞানচর্চায়। প্রাচীন ঐতিহ্যের নাম ভাঁড়িয়ে কিছু অবাস্তব পৌরাণিক কল্পকাহিনি আমাদের চোখের সামনে সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিকমণ্ডলীর প্রবেশাধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবসম্মত জনবিজ্ঞানের উপলব্ধিগুলো হয় সম্পূর্ণ বিস্মৃত, নয় উচ্চবর্গীয় অর্থপুষ্ট জ্ঞানক্ষেত্রের এক কোণে ক্ষমাঘেন্নায় ঠাঁই-পাওয়া। এমনটা সবচেয়ে বেশি ঘটে আদি জনগোষ্ঠীর জ্ঞানভাণ্ডারের অবহেলায়, কখনও (যেমন এ ক্ষেত্রে) অন্য সূত্রে পরবর্তী আবিষ্কারে।

ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের অনন্য কৃতিত্ব, জলাভূমির এই জনকৃষ্টিজাত বৈপ্লবিক ব্যবহার দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা; তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি গবেষণার দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত করা; আর সেই ভিত্তির উপর মানুষের দুটি বিরাট প্রাপ্তি, বিরাট বরের প্রতি আমাদের সচেতন করা। তার একটি স্থানীয় অর্থনীতির উন্মেষ: মাছ-সবজির চাষ, বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ও আনুষঙ্গিক কাজে জীবনধারণ করছে পুব-কলকাতার হাজার পঁচিশ পরিবার। অন্যটি সমস্ত মহানগরের বৃহত্তর পরিবেশগত স্বার্থ: জলাভূমির কল্যাণে একটা পয়সা খরচ না করে (বরং প্রচুর পরিমাণে মাছ-সবজি উৎপাদন করে) এত বড় শহরের সমস্ত বর্জ্য জল শোধিত ও নিষ্কাশিত হচ্ছে, বাতাসের ভয়াবহ দূষণে কিছু মাত্রায় রাশ পড়ছে।

জলাভূমির জনমুখিতা নিয়ে শেষ জীবনে ধ্রুবজ্যোতি উত্তরোত্তর ব্যাপৃত হয়ে পড়েছিলেন। অনামী চাষি জেলে ময়লা-কুড়ানিদের জন্য এই বহুবন্দিত বিশ্বনাগরিক অনুভব করতেন কেবল স্নেহ-মমতা নয়, এক ব্যতিক্রমী সংবেদনশীল শ্রদ্ধা। তাঁর শেষ বই দ্য ট্র্যাশ ডিগার্স এই মানুষদের জীবনগাথা, সাধারণ পাঠকের জন্য লেখা মূলত তাঁরই তোলা ছবির বই। তাঁর শেষ আনুষ্ঠানিক সাফল্য ময়লা-কুড়ানি বর্জ্যকর্মীদের জন্য অসংগঠিত শ্রমিক হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি আদায় করা। সেই স্বীকৃতি কার্যকর করে হতদরিদ্র লোকগুলির কিছু সঞ্চয় ও ক্ষতিপূরণ সুনিশ্চিত করতে শ্রম দফতর বা স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলির অবশ্য আজও বড় হেলদোল নেই।

নগর পরিবেশের বৃহত্তর বিপদ নিয়ে ধ্রুবজ্যোতি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি সারা জীবন সরকারি চাকরি করেছেন; হয়তো সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন একের পর এক, কিন্তু শেষের দিকে হয়ে পড়েছিলেন হতাশ ও রণক্লান্ত। বুঝেছিলেন, জলাভূমি রক্ষায় বড় বাধা ঔদাসীন্য নয়, লোভ, স্বৈরাচার আর এক জেদি উদ্ধত অজ্ঞতা। দেখেছিলেন, যে দফতর বা প্রচলনগুলি জলাভূমি রক্ষার জন্য স্থাপিত হয়েছিলহয়তো বহুলাংশে তাঁরই উদ্যোগেসেগুলি ব্যবহার হচ্ছে জলাভূমি ধ্বংসে সিলমোহর লাগাতে। জলাভূমি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে প্রতিবাদ করে ইস্তফা দিয়েছিলেন গত অগস্টে: পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি, কিন্তু তাঁর বক্তব্যগুলি আদৌ তোয়াক্কা করা হয়নি। মনে পড়ে সংশ্লিষ্ট এক আধিকারিকের অকপট করুণ স্বীকৃতি: ‘দেখুন, আমিও তো সরকারি চাকরি করি!’

অনুমানটা অশোভন ও গ্লানিকর, তবু করতেই হচ্ছে: ধরে নেওয়া যায়, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের তিরোধানে, হয়তো দুএকটা শোকপ্রস্তাব ও স্মরণসভার আড়ালে, অনেক স্বার্থান্বেষী মহলে স্বস্তির ঢেউ বয়ে যাবে। দুর্দিনে সেটাই হয়তো তাঁর সাফল্যের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি। তাঁর প্রচেষ্টা যদি শেষ অবধি ব্যর্থ হয়যার তোড়জোড় অনেক দূর এগিয়েছেসেই দায় কিন্তু বর্তাবে আমাদের সকলের উপর, আর খেসারত দিতে হবে নিজেদেরই ভবিষ্যৎ জীবনের পরিবেশগত সংকটে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE