শেষ জনগণনা বলছে, ৫০ শতাংশ ভারতীয়ের বয়স পঁচিশের কম। আর, ৩৫ বছরের নীচে বয়স ৬৫ শতাংশের সামান্য বেশি মানুষের। দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও আর্থিক বৈষম্যে তিতিবিরক্ত হয়ে চার বছর আগে যাঁরা নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এই তরুণ প্রজন্মের অংশ। আদর্শগত ক্ষোভ তো তাঁদের ছিলই, কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল আশা। মোদীর হাত ধরে ভারতীয় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, একুশ শতকের শুরু থেকে যে ‘ইমার্জিং ইকনমি’র তকমা ভারতের গায়ে সেঁটে রয়েছে, তাকে সরিয়ে অবশেষে ‘ইমার্জ’ করবে আমাদের দেশ— ভারতের উদয় হবে। পরের লোকসভা নির্বাচনও এসে গেল। তরুণ ভারতের আশা আর প্রাপ্তির ব্যালান্সশিট মেলানো যাক।
২০১৫ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ’ নামক একটি যোজনার সূচনা হয়, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো। ২০১৬ সালের বাজেটে বলা হয়েছিল, পরের তিন বছরের মধ্যে এক কোটি ভারতীয়কে যোজনার আওতায় আনা হবে। ২০১৮-র শেষে ‘কৌশল বিকাশ’ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যোজনার আওতায় এসেছেন মাত্র ২৯ লক্ষ তরুণ-তরুণী। এবং তাঁদের মধ্যে চাকরি পেয়েছেন মাত্র ৫,৩৯,০০০ জন, অর্থাৎ সরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের দেশেই চাকরি জুটছে প্রতি ছ’জনে এক জনের। সামনের এক বছরে ছবিটা বদলাবে, সেই আশা ক্ষীণ।
এই ব্যর্থতা যেন কেন্দ্রীয় সরকার বহু আগে টের পেয়েছে। শেষ কয়েকটা বাজেট ভাষণ দেখলে চোখে পড়বে, কৌশল বিকাশ যোজনা নিয়ে অর্থমন্ত্রী চুপ। গত বছর দায়সারা ভাবে জানানো হয়েছিল ভারত জুড়ে আরও ছশোটি জেলায় কৌশল বিকাশ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৮-র ভাষণে সেরেফ এক লাইনে কাজ সেরেছেন জেটলি। জানিয়েছেন, ৩০৬টি কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বাকি আর ক’টা কেন্দ্র খোলা হবে, সেখানে কত জন মানুষ প্রশিক্ষণ পাবেন, শেষ তিন বছরের সাফল্য বা ব্যর্থতার খতিয়ান, সব কিছু নিয়েই অর্থমন্ত্রীর মুখে কুলুপ। প্রশ্ন, পরিকাঠামো সংক্রান্ত অপ্রতুলতার কারণেই কী এই হাল? এবং সেই পরিকাঠামো গড়ে তোলা যাবে না বলেই কি ২০১৫-র প্রতিশ্রুতি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আর বাক্যব্যয় করছে না?
শেষ দু’বছরে আরও একটা শব্দ শোনা যায়নি— ‘নিয়ো মিডল ক্লাস’। শব্দবন্ধটি বিজেপিরই তৈরি। তাঁর প্রথম বাজেটে জেটলি জানিয়েছিলেন যে সমস্ত মানুষ দরিদ্র নন, অথচ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে এখনও ঢুকতে পারেননি, তাঁরাই ‘নিয়ো মিডল ক্লাস’। ২০১৪-র ভোটের অব্যবহিত পূর্বে এবং পরে এই মানুষগুলিকেই দেখানো হয়েছিল সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্যর স্বপ্ন। অথচ গত বছরে বিশ্বব্যাঙ্কের এক সমীক্ষা দেখাচ্ছে ভারতবর্ষের যুব সম্প্রদায়ের (১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যবর্তী বয়সের মানুষ) ৩০ শতাংশ কোনও রকম শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত নন। উন্নত দেশ তো বটেই, উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যেও ভারত প্রায় সবার চেয়ে পিছিয়ে। এমনকী যুদ্ধ, শরণার্থী সমস্যা, সন্ত্রাসবাদে জেরবার তুরস্ক বা দুর্নীতিতে গলা অবধি ডুবে থাকা ব্রাজিলও এই খাতে ভারতের থেকে সামান্য এগিয়ে।
বিজেপি নেতারা বলবেন, কংগ্রেসের আমলের তুলনায় উন্নতি তো হয়েছে। সামান্য উন্নতি হয়েছে, সে-কথা সত্যি। কিন্তু সেই উন্নতি দুই সরকারের সাফল্যের তুলনামূলক মাপকাঠিতে। গোটা বিশ্বের সঙ্গে ভারতের তুলনা করলেই দেখবেন, ২০১৪ আর ২০১৭-র মধ্যে ইতরবিশেষ হয়নি। অথচ শেষ তিন বছরে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বড় ডামাডোল প্রায় কিছুই ঘটেনি। ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং নিম্নগামী মূল্যবৃদ্ধিই ছিল শেষ কয়েক বছরের প্রবণতা। আন্তর্জাতিক বাজারের আনুকূল্য পাওয়া সত্ত্বেও মোদীরা ‘নিয়ো-মিডল ক্লাস’কে চাকরি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ দিতে ব্যর্থ। অথচ এ প্রসঙ্গ উঠলেই সবেধন কুমিরছানা অর্থাৎ জিডিপি-র বৃদ্ধির হিসাবটিকে দেখানো হচ্ছে। সে-হিসাব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটি শেষ কথা হতে পারে না। কারণ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ কেমন আছেন, জাতীয় আয়ের হিসাবে তা বোঝা যাবে না।
সাধারণ মানুষ কেমন আছেন, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইলে গড় আয়ের পাশাপাশি সমগুরুত্ব পাওয়া উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে যে ‘যথেষ্ট পরিমাণ খরচ’ বলে কিছু হয় না, সে-কথা বহু বার বলা হয়েছে, কিন্তু আরও এক বার বললে ক্ষতি নেই। আরও জরুরি মনে করিয়ে দেওয়া যে এই দুই খাতেই অবিলম্বে বৈষম্যের বোঝা কমানো দরকার। ২০১৮-র কেন্দ্রীয় বাজেট আবারও দেখাচ্ছে, সেই সদিচ্ছা সরকারের নেই। বরাদ্দ টাকার শতাংশের হিসাবে স্বাস্থ্য খাতের খরচ গত বাজেটের তুলনায় ০.৩ শতাংশ কমেছে। প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ বাজেট (রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় থাকা প্রকল্পগুলির জন্য) কমে গেছে প্রায় ২.১৮ শতাংশ। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মিশনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৩০৮০১ কোটি টাকা, সেই বাজেট এ বছর কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩০১২৯ কোটি টাকা। মনে রাখা দরকার, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে কিন্তু যাবেন সেই দারিদ্রসীমার কাছাকাছি থাকা মানুষগুলি এবং ‘নিয়ো মিডল ক্লাস’। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব হেল্থ ইনটেলিজেন্সের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে দেখতে পাচ্ছি প্রতি ১০,১৮৯ জন রোগীর জন্য রয়েছেন এক জন সরকারি অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। ১৩০ কোটি মানুষের দেশের সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার রয়েছেন মাত্র এক লক্ষ।
প্রতিশ্রুতির ঘাটতি না থাকলেও প্রতি বছরই শিক্ষা আর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাজেটে বিস্তর ঘাটতি থাকে। শিক্ষায় গত বছরের তুলনায় প্রায় চার শতাংশ বাজেট বেড়েছে। মুশকিল হল, ২০১৮-র জানুয়ারিতে মূল্যবৃদ্ধির হার ৫.০৭%। সুতরাং, নেট বিচারে বৃদ্ধির ঘরে কী জমা পড়ল, বুঝতে সমস্যা নেই। অন্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে এই ‘বৃদ্ধি’ পরিমাণ হাস্যকর রকমের কম।
মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলি পরের কিছু দশক জুড়ে শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মসংস্থানে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন বা জাপানের মতো আমাদের অর্থমন্ত্রীও তাঁর বাজেট ভাষণে সে-কথা তুলেছেন, এবং জানিয়েছেন নীতি আয়োগের মাধ্যমে ভারত সরকার এই বিষয়গুলিতে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণা খাতে যথেষ্ট বিনিয়োগ করবে। যথেষ্ট বিনিয়োগের পরিমাণ? ৪৮০ মিলিয়ন ডলার। চিনের এ বছরে এই মেশিন লার্নিং এবং আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স খাতে বরাদ্দ চার বিলিয়ন ডলারের ওপর। অর্থাৎ, ভারতের আট গুণেরও বেশি। চিনের সঙ্গে ভারতের তুলনা চলে না ঠিকই, কিন্তু তা বলে এই ফারাক?
২০১৪ সালে প্রায় ১২ কোটি নতুন ভোটার ছিলেন। ২০১৯-এ প্রথম বার ভোট দেবেন আরও ১৩ কোটি। এই ২৫ কোটির জন্য কোনও সুখবর এ বছরের বাজেটেও কার্যত নেই। ‘ইমার্জিং ইকনমি’-র তকমা থেকে মুক্তি এত সহজে মেলার নয়।
ইস্তানবুলের সাবাঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy