— প্রতীকী ছবি
উরির ঘটনার পর সম্প্রতি আরও এক বার দেশপ্রেম প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। এ দেশ আমাদের সবার। আমাদের ভালবাসা যে দেশকে ঘিরে থাকবে সব দিক দিয়ে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই, তাতে কোনও অস্বাভাবিকতাও নেই।
কিন্তু দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়? দেশ মানে কি শুধু একটা মানচিত্র? দেশ মানে কি সীমান্ত ঘিরে থাকা অতন্দ্র প্রহরীরা? দেশ বলতে কি শুধু বিরাট কোহালির একটা সেঞ্চুরি এবং তার জন্য আসমুদ্র হিমাচলের প্রবল করতালির ধ্বনি?
দেশ বলতে আসলে যা বোঝায়, দেশের সেই জনগোষ্ঠীকে, সেই মানুষকে, সেই সহনাগরিকদের কোথাও ভুলতে বসিনি তো আমরা? ভারত রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে যে ভাবে লহমায় ঐক্যবদ্ধ হই, ভারতবাসী আক্রান্ত হলে তো ততটা ঐক্যের ভাব মনে জাগে না আমাদের মধ্যে! তা যদি না হয়, তা হলে উত্তর-পূর্বের মানুষ দিল্লিতে বা বেঙ্গালুরুতে হেনস্থার শিকার হন কেন? কেন উত্তর-পূর্বের কোনও রাজ্যে নির্দিষ্ট একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে ‘খেদানো’র ডাক দেওয়া হয়? কেন দেশের পশ্চিম প্রান্তের কোনও রাজ্যে রব ওঠে ‘আমচি মুম্বই’?
ভেদের পরিসর শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। এ দেশে ভেদরেখাটা আরও দগদগে, আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন, যখন ধর্ম-বর্ণ-জাতির বিচারে সহনাগরিকের মান-মর্যাদা নির্ধারন করি আমরা। এই বর্বর বিভাজনগুলো জিইয়ে রাখতে যখন উন্মত্ত হয়ে উঠি, তখন দেশটা কোথায় থাকে? শুধু কাগজের মানচিত্রে নিশ্চয়ই!
গুজরাতে ‘উচ্চ বর্ণের’ গৃহস্থালীর সামনে পড়ে থাকা গরুর শব সরানোর প্রয়োজন পড়তেই দলিত বাড়িতে তলব গেল। অন্তঃসত্ত্বা দলিত ঘরনী জানালেন, তিনি শব সরাতে পারবেন না। অতএব প্রবল আক্রোশে, মনুষ্যত্ব ভুলে, সভ্যতার সমস্ত রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে অন্তঃসত্ত্বার গর্ভে পদাঘাত!
দেশটা কার? ‘উচ্চ বর্ণের’ আঙিনা থেকে গরুর শব সরানোকে বেশি জরুরি মনে না করে, গর্ভস্থ সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলে মনে করায় যে অন্তঃসত্ত্বা নারী গর্ভে পদাঘাত পেলেন, এ দেশ তাঁর? নাকি দেশটা ওই পদাঘাতকারীর?
দেশের আইন-কানুন কার জন্য? প্রশাসন কার জন্য? বিচার ব্যবস্থা কাদের জন্য? মুখ্যমন্ত্রীরা কাদের স্বার্থে নির্বাচিত হন? প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাউকে বেছে নেওয়া হয় কার কল্যাণের জন্য? স্বাধীনতার পর থেকে সাতটা দশক কেটে যাওয়া সত্ত্বেও, এই সব প্রশ্নের কোনও উত্তর এখনও নেই।
আজ ভারত রাষ্ট্র আক্রান্ত বলে আমরা প্রবল রোষে প্রত্যাঘাতের প্রতীক্ষায়। সংশয় নেই, এই প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশিত। কিন্তু ভাষার নামে, প্রদেশের নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে দেশ যখন রোজ আক্রান্ত হয়, তখনও তো এই রোষই প্রত্যাশিত। তখন তো প্রত্যাশা পূরণ হয় না!
রাষ্ট্র আক্রান্ত হলেই রক্ত গরম হয়ে ওঠে আমাদের। কিন্তু ভারতভূমির অগণিত শিরা-উপশিরায় যে বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ রক্তস্রোত প্রবহমান, তাকে আমরা চিনতেই পারিনি এখনও। যদি পারতাম, তা হলে রোজকার এই আত্মঘাতী রক্তক্ষরণ সইতে হত না আমাদের দেশকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy