Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

বিরোধিতারও একটা পরিবর্তন দরকার

বিরোধীদের জোট থাকতেই হবে এমন নয়। তবে বাংলার মানুষ হয়তো চাইবে জোট থাকুক, একটা প্রকৃত সমালোচক বিরোধী গোষ্ঠী যাতে শাসককে তার ভুলভ্রান্তি ও নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাখে। লজিকের প্রসঙ্গে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘আমি যদি যুক্তি প্রয়োগ করে বুঝতে পারি যে, আমার বিশিষ্ট বন্ধু হার্ডির (গণিতজ্ঞ জি এইচ হার্ডি, যিনি রামানুজনের কেমব্রিজ যাত্রার বন্দোবস্ত করেন) আগামী কাল মৃত্যু হবে আর সে যদি সত্যিই মরে যায়, তা হলে বন্ধুবিচ্ছেদের ব্যথায় মন তো ভরে যাবেই, কিন্তু তবুও এ কথা ভেবে ভাল লাগবে, যে আমার অনুমান ঠিক ছিল, লজিকের প্রয়োগে আমি ভুল করিনি।’ নির্বাচনের আগে যে বামপন্থীরা আঁচ করেছিলেন জোট জিতবে না, তাঁদের মনের অবস্থা বোধ করি সে রকমই।

ধরি ধরি। (বাঁ দিক থেকে) সূর্যকান্ত মিশ্র, দীপা দাশমুিন্স ও সোমেন মিত্র। এপ্রিল ২০১৬। ছবি: সুদীপ আচার্য

ধরি ধরি। (বাঁ দিক থেকে) সূর্যকান্ত মিশ্র, দীপা দাশমুিন্স ও সোমেন মিত্র। এপ্রিল ২০১৬। ছবি: সুদীপ আচার্য

অর্ধেন্দু সেন
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০০:৩৭
Share: Save:

লজিকের প্রসঙ্গে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘আমি যদি যুক্তি প্রয়োগ করে বুঝতে পারি যে, আমার বিশিষ্ট বন্ধু হার্ডির (গণিতজ্ঞ জি এইচ হার্ডি, যিনি রামানুজনের কেমব্রিজ যাত্রার বন্দোবস্ত করেন) আগামী কাল মৃত্যু হবে আর সে যদি সত্যিই মরে যায়, তা হলে বন্ধুবিচ্ছেদের ব্যথায় মন তো ভরে যাবেই, কিন্তু তবুও এ কথা ভেবে ভাল লাগবে, যে আমার অনুমান ঠিক ছিল, লজিকের প্রয়োগে আমি ভুল করিনি।’ নির্বাচনের আগে যে বামপন্থীরা আঁচ করেছিলেন জোট জিতবে না, তাঁদের মনের অবস্থা বোধ করি সে রকমই।

নির্বাচন চলাকালীন একটা সময় অবশ্য জোট প্রায় জিতেই গিয়েছিল, যখন দেখা গেল নির্বাচন কমিশনের কড়া ব্যবস্থায় মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারছেন, এমনকী সল্ট লেকের মানুষও। এ-ও দেখা গেল যে প্রচুর ভোট পড়ছে। একটা ধারণা আছে, বেশি ভোট পড়লে বিরোধীরা বেশি পায়। তৃণমূল শিবিরে অস্বস্তি স্পষ্ট। পুলিশ এত সক্রিয় কেন? ভীষণ দুশ্চিন্তা। জোট শিবির উৎসাহিত এবং খুশি। বুথফেরত সমীক্ষায় অবশ্য বোঝা গেল, ফল আশানুরূপ হবে না।

জোটের হয়ে প্রচারে নেমেছিলাম আমিও। জোট জিতলে খুব খুশি হতাম। একটা জবরদস্ত লড়াই করে হারলেও খুশি হতাম। কিন্তু সে সব যখন হল না, আমারও অখুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু আমি অখুশি নই। কারণ গণতন্ত্রে বিরোধী দলেরও কিছু করণীয় আছে। অবশ্যই শাসকের কাজ অনেক বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিরোধী দল হল দুই পায়ের এক পা। একটি পা প্লাস্টারে থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র সব সময়েই খোঁড়া হয়ে থাকবে।

হয়েছেও অনেকটা তাই। আমলাদের ‘কম্পালসরি ওয়েটিং’ বলে একটা শাস্তি আছে। ওয়েটিং-এ থাকলে কোনও কাজ থাকে না। একমাত্র কাজ হয় কোনও রকমে একটা পোস্টিং জোগাড় করা। বিরোধী দলগুলিকে দেখলে অনেক সময় মনে হয় তাদের একমাত্র কাজ হল ক্ষমতায় ফেরা। তা কেন? বিরোধী হয়েও জনকল্যাণমূলক কাজ করা যায়, কিন্তু তার নমুনা বিরল।

তবে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে আগে বুঝতে হবে বিরোধী জোট হেরে গেল কেন? সহজে সে উত্তর মিলবে না। সেই বিশ্লেষণ করবেন বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কোনও দিন কি বোঝা যাবে কে কাকে কেন ভোট দিয়েছে? অনেকে বলবেন জোট হল বড় দেরিতে। বুদ্ধবাবু আর রাহুল গাঁধীর মিটিং আরও এক মাস আগে হলে কী হত জোটের ভবিষ্যৎ? বিভ্রান্তিও ছিল, বিশেষ করে পুরনো কর্মীদের মধ্যে, যাঁরা বহু দিন পরস্পরের বিরোধিতা করেছেন। অনেক নেতাও জোটকে পুরো মেনে নেননি। মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, ভোটের আগে তা ঘোষণা করে দেওয়া উচিত ছিল। জোট সরকারের নীতি কী হবে মানুষ বুঝতে পারেনি। দুই দল একসঙ্গে থাকতে পারবে, না ফের নির্বাচনে যেতে হবে সে প্রশ্নও ছিল।

অনেকে বলছেন মানুষ উন্নয়নের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছে। বড় কারণের মধ্যে— রেশন ব্যবস্থার উন্নতি, দু’টাকা কিলো চাল, রাজ্য হাইওয়েগুলির উন্নতি, হাসপাতাল, আইটিআই, নিয়ন্ত্রিত বাজার ইত্যাদি। শহরের মানুষ, বিশেষ করে কলকাতার মানুষ খুশি, কারণ সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। তা ছাড়া বাংলায় শাসক-বিরোধ দানা বাঁধতে সময় লাগে। যাঁরা বামফ্রন্টকে ৩৪ বছর সময় দিয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই তৃণমূলকেও যথেষ্ট সময় দেবেন।

কিন্তু দুর্নীতির কী হল? প্রথমে শুনলাম শহরাঞ্চলে এর প্রভাব পড়তে পারে কিন্তু গ্রামেগঞ্জে এটা কোনও বিষয়ই না। গরিব মানুষ রেশনের চাল পেয়ে এত খুশি যে তারা দুর্নীতির সঙ্গে আপস করতে রাজি? কথাটা মেনে নিতে ইচ্ছে হল না। নির্বাচনের ফলাফলে অবশ্য দেখলাম, শহরের মানুষও দুর্নীতির প্রশ্নকে গুরুত্ব দেয়নি। এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, নিয়ো-লিবারালিজমের যুগে দুর্নীতি কোনও বিষয় নয়। কিন্তু কেরলে এলডিএফ তো উমেন চান্ডি সরকারের দুর্নীতিকে বিষয় করে ভাল ফল পেয়েছে। ওঁরা কি এখনও প্রস্তরযুগে? তৃণমূল যদি দশটি আসন বেশিও পেত, কিন্তু যদি নারদ স্টিং-কাণ্ডে যাঁদের ছবি দেখা গিয়েছে তাঁরা হারতেন, তা হলে আশ্বস্ত হতাম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষমতাও তো উন্নয়নের লক্ষণ।

তবে এ কথা ঠিক যে, একটা বোতাম টিপে বড় জোর বলা যায় হ্যাঁ কি না। আমরা রেশন ব্যবস্থার উন্নতিতে খুশি কিন্তু তোলাবাজিতে উদ্বিগ্ন, রাস্তায় আরও আলো চাই কিন্তু কোনও উড়ালপুল যেন কোনও দিন ভেঙে না পড়ে— এমন জটিল বার্তা ভোটের মাধ্যমে দেওয়ার উপায় নেই। তাই বিজয়ী দলের ভাবা উচিত হবে না যে মানুষ উন্নয়নের পক্ষে— সম্ভব হলে দুর্নীতি বাদ দিয়ে, সম্ভব না হলে দুর্নীতি সমেত। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বাংলায় দুর্নীতি নেই। কথাটা এক দিক দিয়ে সত্যি। যেখানে পুলিশ নেই, তদন্ত নেই, প্রসিকিউশন নেই, বিচার নেই, সেখানে দুর্নীতি থাকে কী করে?

এখানেই বিরোধীদের গুরুদায়িত্ব। বিরোধী দলের কাজ হবে মানুষের ভোটের বিশ্লেষণ করা ছাড়াও তাঁদের মনের কথা খুঁজে বের করা। এই কথা বুঝে তা সম্পূর্ণ ভাবে শাসকের কাছে পৌঁছে দেওয়া তাঁদেরই কাজ। এ কাজ শক্ত এবং সময়সাপেক্ষ। কাজটা কিন্তু জরুরি। জোট যদি সত্যি জোট হয়, শুধু আসন সমঝোতা না হয়, তা হলে এই সূত্র ধরে ভাববার অবকাশ আছে।

বিরোধীদের জোটবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। তবে বাংলার মানুষ হয়তো চাইবে জোট থাকুক। এটা শুধু আসন সমঝোতার জন্য নয়। একটা প্রকৃত সমালোচক বিরোধী গোষ্ঠী যাতে শাসককে তার ভুলভ্রান্তি ও নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাখে, সে জন্য। ঠিক সেই কারণেই নতুন ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। বোঝা যাক দুই আর দুই যোগ করলে চারের বেশি হয়।

মুখ্যমন্ত্রী যে বলেছেন বাংলাকে এক নম্বর করবেন— বিরোধীরা সেই প্রত্যয়কে স্বাগত জানাক। মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতা করার জন্য শপথগ্রহণ বয়কট করা কি খুব জরুরি? এই অনুষ্ঠান বয়কট না করে কি হিংসা আর আক্রমণের প্রতিবাদ করা যায় না? অন্যায়কে যেমন অন্যায় বলতে হবে, খারাপকে খারাপ বলতে হবে, তেমনই ভালকে ভাল বলতে হবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি অনিবার্য হয়ে উঠবে।

মিশ্র সরকার এ বার দেখা হল না। তাতে কী? বছর পাঁচেক পরে আবার সুযোগ আসবে।

ভূতপূর্ব মুখ্যসচিব, রাজ্য সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE