Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আমরা বিষণ্ণ নই

বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব জুড়ে থাকল রাজনীতিকদের দুর্নীতি। আমরা শোকার্ত হলাম না। সবই চলে, মেনে নিয়েছি কি? যু ধিষ্ঠিরের রথের চাকা শেষমেশ মাটি ছোঁবেই। নিয়তি। শেষ অবধি বেঁচে না থাকাই বুঝি অহংকারের ভবিতব্য। পশ্চিমবঙ্গকে নিয়েও বাঙালির একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল— এ রাজ্যের নেতারা আর যা-ই হোন, দুর্নীতিগ্রস্ত নন। বাংলার রাজনীতিতে দুর্নীতি কখনও মূল প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৫
Share: Save:

যু ধিষ্ঠিরের রথের চাকা শেষমেশ মাটি ছোঁবেই। নিয়তি। শেষ অবধি বেঁচে না থাকাই বুঝি অহংকারের ভবিতব্য। পশ্চিমবঙ্গকে নিয়েও বাঙালির একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল— এ রাজ্যের নেতারা আর যা-ই হোন, দুর্নীতিগ্রস্ত নন। বাংলার রাজনীতিতে দুর্নীতি কখনও মূল প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি। তীব্র আক্রমণের মুহূর্তেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে পারেননি, জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অসৎ, রাজনীতিকে তাঁরা অন্যায় পথে অর্থোপার্জনের জন্য ব্যবহার করেন। বরং, পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরও প্রফুল্ল সেনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে গুটিকয় ধুতি-পাঞ্জাবি বই অন্য কিছু ছিল না, অথবা অশোক ঘোষ-বিমান বসুরা ক্ষমতার শীর্ষে থাকার সময়ও কী ভাবে সাধারণস্য সাধারণ জীবনযাপন করে গিয়েছেন, সেই গল্প বলতে বাঙালির চোখের কোণে উঁকি দিয়ে যেত এক আশ্চর্য অহংকার— অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার অহংকার।

তৃণমূল কংগ্রেসের পাঁচ বছর এসে সেই অহংকারকে নিয়ে গেল। চিরতরেই।

এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের একটা গোটা বিধানসভা নির্বাচন দাঁড়াল দুর্নীতির প্রশ্নের ওপর। শিল্প নয়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য নয়, এমনকী শাসক দলের বাহুবলীদের প্রচণ্ড সন্ত্রাসও নয়, এই বিধানসভা নির্বাচনের আদি-মধ্য-অন্ত জুড়ে থাকল শুধু দুর্নীতির প্রশ্ন। সারদা-নারদ, সিন্ডিকেট, ভেঙে পড়া উড়ালপুল, সব কিছুই আঙুল তুলে নির্দেশ করল একটা অমোঘ বাস্তবের দিকে— পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি থেকে নৈতিকতা বিদায় নিয়েছে।

কামারহাটিতে নাকি প্রচারে বেরিয়ে জোটকর্মীরা একটাই প্রশ্ন করছেন: “মদন মিত্র যদি জেতেন, কোনও কাজে বিধায়কের সই দরকার হলে আনতে জেলে যাবেন তো”? কৌশলটি চমৎকার, সন্দেহ নেই। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও যে এই প্রশ্ন করার অবকাশ তৈরি হতে পারে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে হয়তো ভাবাও যেত না। কেন সারদা কেলেঙ্কারির মতো মারাত্মক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কারাবন্দি মদন মিত্রকেই প্রার্থী হিসেবে বেছে নিতে হয়? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি কোনও দিন সৎ ভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেন, তবে দুটি মাত্র সম্ভাবনা থাকে। এক, মদন মিত্র এমন কিছু জানেন যে তাঁকে চটানোর ঝুঁকি নেওয়া অসম্ভব; দুই, দুর্নীতির অভিযোগকে মুখ্যমন্ত্রী এতখানি গুরুত্ব দেন না যে, কারও তাঁর দলের প্রার্থী হতে সমস্যা হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গকে আগে কখনও এমন সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে হয়নি।

যে উড়ালপুল ভেঙে ছাব্বিশ জন মানুষের মৃত্যু হল, তা-ও হয়ে উঠল রাজনৈতিক তামাশার উপজীব্য। এক পথসভায় সিপিআইএম-এর বক্তা বললেন, ‘আগে রাস্তা পার হওয়ার আগে ডাইনে-বাঁয়ে দেখলেই চলত। এখন তো ওপর দিকেও তাকাতে হয়, দেখতে হয় উড়ালপুল ভেঙে পড়ছে কি না।’ শ্রোতারা হাসলেন, হাততালিও দিলেন। মৃত্যু নিয়েও তবে মশকরা সম্ভব? এই পাপের দায়ও বহন না করে মুখ্যমন্ত্রীর উপায় নেই। ভেঙে পড়া উড়ালপুলের ভগ্নাবশেষ সরাতেই যে দুর্নীতির কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ল। জানা গেল, আপাতদৃষ্টিতে যা দুর্ঘটনা, তা আসলে গণহত্যা— সর্বব্যাপী লোভের ভার বইতে পারেনি বিবেকানন্দ সেতুর থামগুলো। যে উন্নয়নের জোয়ারে রাজ্যকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে সরকারি কর্মীদের মহার্ঘভাতা দিয়ে উঠতে পারেনি রাজ্য সরকার, সেই উন্নয়ন কমিশনের হিসেবে কার কার পকেটে ঢুকছে, বিরোধীরা সেই হিসেব চাইবেন বইকী। যখন রটে গিয়েছিল যে প্রফুল্ল সেন বেনামে স্টিফেন হাউস নামক বাড়িটি কিনে নিয়েছেন, অথবা যখন বিরোধীরা জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলেছিলেন, বঙ্গ-রাজনীতির সেই বিরল মুহূর্তগুলোতেও কিন্তু উন্নয়নের হাত মুচড়ে নিজের পকেট ভরার প্রসঙ্গ ওঠেনি। এই পোড়া রাজ্যে অন্তত সেটুকু অকল্পনীয় ছিল।

এমনকী সারদা কেলেঙ্কারির সময়ও অকল্পনীয় ছিল যে সাধারণ মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। মানুষ মানবে না বলেই বিরোধীরাও কখনও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অসততার অভিযোগ তোলেননি। ২০১৬ সাল কেড়ে নিল সেই জায়গাটুকুও। দেওয়ালে লেখা হল, “মানুষের লুঠ হাজার কোটি/ কে খেয়েছে? হাওয়াই চটি।” তাঁর ছবি এঁকে তলায় “সততার প্রতীক” লিখে কেটে দিয়ে লেখা হল “সারদার প্রতীক”। সুদীপ্ত সেন তাঁর আঁকা ছবি এক কোটি ছিয়াশি লক্ষ টাকায় কিনেছেন, এই খবরও যা পারেনি, নারদের ভিডিয়ো দেখে, সব্যসাচী দত্তের সিন্ডিকেট-স্বীকারোক্তি শুনেও তাঁর চর্চিত নীরবতা সেই কাজটা করে দিল। মানুষ বিশ্বাস করে নিলেন, তা হলে দিদির ব্যক্তিগত সততাও প্রশ্নাতীত নয়। কোনও সৎ মানুষ কি এমন ভাবে দশ দিক থেকে অসৎ মানুষ দ্বারা পরিবৃত থাকতে পারেন?

সিন্ডিকেটের পক্ষে একটা সাফাই শোনা যাচ্ছে। সিন্ডিকেটের প্রাণকেন্দ্রের কাছাকাছি এক জনসভায় তৃণমূলের বক্তা যা বললেন, সহজ কথায় তার মানে দাঁড়ায়— সিন্ডিকেট আসলে ছদ্মবেশী রবিনহুড। বড়লোক প্রোমোটারের থেকে টাকা নিয়ে তা বিলিয়ে দেয় গরিব কর্মসংস্থানহীন তরুণদের মধ্যে। বামফ্রন্ট মিইয়ে গেলেও এই বঙ্গের চেতনায় এখনও সাম্যবাদের দাপট প্রবল। ফলে, ‘সমবণ্টন’-এর এ হেন পদ্ধতিকে হয়তো অনেকেই অন্যায় মনে করবেন না। কিন্তু নারদ-ভিডিয়োকে ব্যাখ্যা করতে পারে, এমন যুক্তি সম্ভবত তাঁদের ভাঁড়ারেও নেই। কাজেই বক্তা বললেন, “আমাদের কিছু নেতা-মন্ত্রীকে নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, আমি তার জবাব দেব না। তার জবাব দেবেন সাধারণ মানুষ। ইভিএম-এ।” পথ চলতে চলতে মিটিং দেখে থমকে দাঁড়ানো মধ্য-সত্তর মৃদুস্বরে বললেন, “উত্তর থাকলে তবে তো দিবি’’।

স্থানীয় অভাব অভিযোগের প্রশ্নগুলোও এই দফায় জড়িয়ে গেল দুর্নীতির সঙ্গেই। বর্ধমান থেকে ঘুরে এসে এক সহকর্মী জানালেন, সেখানে মানুষ ছড়া কাটছেন, “কাকে ভোট দিলাম কাকা/ মিলে ধান, ব্যাঙ্কে টাকা/ চাষির শুধু দু’হাত ফাঁকা।” সে জেলায় নাকি এফসিআই-এর কাছে প্রোকিয়রমেন্টে ধান বেচতে গেলেও সিন্ডিকেটকে নজরানা দিতে হচ্ছে। সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে শোনা যাচ্ছে, “বাঁধের টাকা কোথায় গেল? তৃণমূল লুটে খেল।” বামফ্রন্টের জমানায় স্থানীয় নেতারা স্বজনপোষণ করতেন না, অথবা উন্নয়ন খাতে আসা টাকার কিয়দংশ তাঁদের পকেটে ঢুকত না, এমন দাবি বোধ হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও করবে না। কিন্তু, সমস্ত সুতোই জমা পড়বে দুর্নীতির লাটাইয়ে— এই বাস্তব রচিত হয়েছে গত পাঁচ বছরে।

স্বাভাবিক ভাবেই নির্বাচনের প্রচার জুড়ে দুর্নীতির আখ্যান থাকল। অথচ, কী আশ্চর্য, এক বারও কানে এল না কোনও বিষাদের সুর— এত বছরের যত্নলালিত অহংকার হাওয়ায় মিলিয়ে গেলে যে বিষাদ অনিবার্য। নির্বাচনের প্রচার হয়তো সে বিষাদের ভার বহন করতে পারত না। কিন্তু, আমরাও কি ততখানি বিষণ্ণ হলাম? বিদ্রূপ শানানোর আগে, অথবা দলের নেতা-মন্ত্রীদের আড়াল করার সময়, ভাবলাম কি— যা গেল, তার আর কখনও ফিরবে না?

নাকি, নিজেদের অজান্তেই আমরাও এই দুর্নীতিকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিতে শিখেছি? নিজেদের মনেই বলেছি, চলতা হ্যায়? এমনটা তো হয়েই থাকে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE