উন্মত্ত আবেগের একটা সীমা থাকা দরকার। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আক্রোশ যে রয়েছে, সে অনস্বীকার্য। কিন্তু সে আবেগে সমস্ত হিতাহিত ভুলে উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারি না।
নিজের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক ভিত্তি পুনরুদ্ধার করতে মহারাষ্ট্রের কোনও এক রাজনৈতিক নেতা হুঙ্কার ছাড়লেন— পাকিস্তানের শিল্পীদের বলিউডে কাজ করতে দেওয়া হবে না, ভারতে থাকতে দেওয়া চলবে না। রব ওঠা মাত্র আমাদের মধ্যেই এক দল ভূতগ্রস্তের মতো বলতে শুরু করল, পাক শিল্পীদের ভারত ছাড়তে হবে, ছাড়তেই হবে। কর্ণ জোহর প্রতিবাদ করলেন এই চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতার। রাজনৈতিক ঘৃণার কারবারিরা তৎক্ষণাৎ তাঁর দফতর ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করে দিলেন। সইফ আলি খানও প্রতিবাদ করলেন। এ বার হয়তো তাঁকেও ঘৃণার কারবারিদের রোষানলে পড়তে হবে। হয়তো শুনতে হবে, নিজের পদবী খান বলেই তিনি ফওয়াদ, মাহিরাদের ভারত ছেড়ে যাওয়ায় কষ্ট পাচ্ছেন। শাহরুখ খান, সলমন খান, আমির খানদের উদ্দেশেও সে রকম কথা ছিটকে আসতে দেখেছি বিভিন্ন সময়ে। সইফ আলিই বা বাদ যাবেন কেন!
এই চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতাটাই অস্বস্তির সবচেয়ে বড় কাঁটা। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরোধের প্রলম্বিত এবং উত্তপ্ত ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। সে বিরোধের ফয়সলা হয় সামরিক স্তরে হতে হবে, অথবা কূটনৈতিক স্তরে। কিন্তু যত দিন না সে ফয়সলা হচ্ছে, তত দিন কি দুই দেশের জনগোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে ইতিবাচক আদানপ্রদানগুলোও বন্ধ রাখবে? ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে জ্বলতে থাকা রাজনৈতিক আগুন যদি কোনও দিন না নেভে, তা হলে এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক, মানবিক আদানপ্রদানগুলোও কি চিরকালের জন্য মুলতুবি থাকবে?
রাজনীতিটাকেই জীবনের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও মহৎ নির্ণায়ক শক্তি মানতে যাঁরা নারাজ, তাঁরা যদি মানুষের সঙ্গে মানুষের এক অন্যতর সেতু বাঁধার কথা ভাবেন, তা হলেই মার মার রবে তাঁদের দিকে তেড়ে যাওয়ার অধিকার আমাদের বিন্দুমাত্র নেই। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আজ সেই পথে। উন্মত্ত আবেগে ভেসে তীব্র যুদ্ধ যুদ্ধ জিগির তুলছি আমরা, লড়াই-আঘাত-প্রত্যাঘাত ছাড়া অন্য কোনও কথা শুনতেই চাইছি না, কেউ অন্য সুরে বললেই দেশদ্রোহী তকমা দিচ্ছি।
কোনও কারণে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের উপলব্ধি— উরি হামলার পর আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি, বরং ভারতই বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কেজরীবালের উপলব্ধি ঠিক হোক বা ভুল, তাঁর উপলব্ধির প্রকাশকে আমরা কোন অধিকারে রুখতে পারি? কেজরীবাল হন বা সাধারণ নাগরিক, তাঁর মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কী ভাবে খর্ব করতে পারি? যুদ্ধ ছাড়াও আরও অনেক কিছু ইতিবাচক ভাবতে ইচ্ছা করছে যাঁর, তাকেই আমরা দেশদ্রোহী বলে দেব! জনমানসে এমন উন্মত্ততা স্বার্থান্বেষী রাজনীতির স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে। কিন্তু আমজনতার বিন্দুমাত্র উপকার তাতে নেই।
উন্মত্ততা যদি এই পর্যায়ে পৌঁছয়, তবে তা আত্মঘাতী হয়ে উঠতে চলেছে নিঃসন্দেহে। যুদ্ধ সব সময়ই অন্তিম বিকল্প। তার আগেও অনেকগুলো পথ থাকে। সেই পথগুলো খুঁজে বার করাই জরুরি। দেশ যখন আর্থিক বৃদ্ধির শিখরে, ভারতের প্রান্তে প্রান্তে যখন সমৃদ্ধির স্পর্শ, ভারত যখন এক সুবিশাল অর্থনীতি হিসাবে বিশ্ব-মঞ্চে নবোদিত, সে সময় যুদ্ধ এড়ানোর কোনও চেষ্টা আমরা করব না? ভবিষ্যতের গর্ভে আমাদের জন্য লুকিয়ে যে অসীম সম্ভাবনা, তাকে চেনার চেষ্টাই করব না? যুদ্ধ ছাড়া কিছু ভাববই না! যদি শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ি যুদ্ধে, হানাহানি কিন্তু একতরফা হবে না। আমাদের দিকেও ধেয়ে আসবে গুলি, বোমা, গোলা, বারুদ, গ্রেনেড, মর্টার, ক্ষেপণাস্ত্র! যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছিটকে আসা অসংখ্য স্প্লিন্টার আমাদের নগরে, শহরে, গঞ্জে, গ্রামে, পাড়াতে, বাড়িতে অসংখ্য ক্ষত এঁকে দেবে। সীমান্তের ও পারে শুধু নয়, এ পারেও ধ্বংসলীলা চলবে। সে ধ্বংসলীলা আমাদের জীবনে, আমাদের যাপনে, আমাদের মননে গভীর ছাপ রেখে যাবে। নেতির পদচিহ্ন রেখে যাবে।
দেশপ্রেমের নামে যুদ্ধের উন্মত্ত জিগির চার পাশে। সে স্রোতে ভেসে সংবেদনশীলতা হয়তো লোপ পাচ্ছে হয়তো অনেক মন থেকে। কিন্তু এখনও সংবেদনশীল মনটাকে ঘুম পাড়িয়ে দেননি যাঁরা, তাঁদের কণ্ঠস্বরটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা ভয়ঙ্কর। কারণ ওই কণ্ঠস্বরইগুলোই আশার শেষ সলতে আমাদের কাছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy