Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

জুতা আবিষ্কার: সমস্যা বদলায় না

দুর্নীতি তাড়ানোর দুটো পথ। এক, সব কুচক্রীদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা। দুই, নেতানেত্রীদের প্রত্যেকের পায়ে একটা নতুন জুতো পরিয়ে দেওয়া। সততার জুতো। যেমন মত, তেমন পথ। মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়ে, ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র?— মন্ত্রী গবুরায়কে প্রশ্ন করেছিলেন রাজ্যেশ্বর হবুচন্দ্র। কবে ছিল তাঁর রাজত্বকাল? কোন জেলায় ছিল তাঁর রাজধানী? সে বিষয়ে কোলব্রুক বা প্রিন্সেপ কিছু লিখে যাননি। তবে মহারাজের দুশ্চিন্তা দেখে মনে হয় সে জেলা তখনও নির্মল হয়নি।

দিকে দিকে সেই বার্তা। নারদ নিয়ে বামফ্রন্ট মিছিল। মার্চ ২০১৬

দিকে দিকে সেই বার্তা। নারদ নিয়ে বামফ্রন্ট মিছিল। মার্চ ২০১৬

অর্ধেন্দু সেন
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৬ ০০:১০
Share: Save:

মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়ে, ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র?— মন্ত্রী গবুরায়কে প্রশ্ন করেছিলেন রাজ্যেশ্বর হবুচন্দ্র। কবে ছিল তাঁর রাজত্বকাল? কোন জেলায় ছিল তাঁর রাজধানী? সে বিষয়ে কোলব্রুক বা প্রিন্সেপ কিছু লিখে যাননি। তবে মহারাজের দুশ্চিন্তা দেখে মনে হয় সে জেলা তখনও নির্মল হয়নি। তাই মন্ত্রী গবুচন্দ্রও প্রশ্নটি যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে শোনেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেন। অন্য সময় হলে হয়তো মন্ত্রী একটা কমিটি গঠন করেই দায় সারতেন। কিন্তু প্রশাসনিক টালবাহানা, দীর্ঘসূত্রিতা, এ সব হল গণতন্ত্রের দোষ। আমাদের রাজ্যে কিছু দিন আগেও আমরা তা দেখেছি। রাজতন্ত্রে এদের ঠাঁই নেই; রাজকর্মচারী ঠিক সময় আসে, ঠিক সময় যায়। অফিসে কোনও কাজ পড়ে থাকে না। রাজা প্রতিশ্রুতি দেবেন কি! তার আগেই তা পূর্ণ হয়ে যায়।

মন্ত্রী তাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমস্যার সমাধানে। সাড়ে সতেরো লক্ষ ঝাঁটা কেনা হল। রাজার আদেশ তাই টেন্ডার ডাকার প্রয়োজন হল না। কিন্তু ঝাঁট দেওয়ার লোক কোথায়? রাতারাতি পুলিশ নামিয়ে ইন্টারভিউ নেওয়া হল, কোথাও মিনিটে দশ জন তো কোথাও ঘণ্টায় হাজার। মাস তিনেকের মাথায় নিতে হল একুশ লাখ ভিস্তি। গোটা বিশ্বে কোথাও কখনও এত কম সময়ে এত কর্মসংস্থান হয়নি। লোকে বললে রাজা ধন্যি। মন্ত্রী কিন্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন অর্ধেক বেতন এখন দেব, অর্ধেক পরে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শেষটা যে ভাল হয়নি তা আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের লেখায়। বাঙালির সৌভাগ্য যে বৃদ্ধ চামার কুলপতি রাজার পায়ের কাছে বসে তাঁর জন্য একজোড়া জুতো বানিয়ে দেন। রাজ চরণ বিপদমুক্ত হয়।

যুগ বদলায়, সমস্যা বদলায় না। বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে বাংলার মানুষ দেখল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা নেত্রী এক অচেনা লোকের কাছে বান্ডিল বান্ডিল টাকা নিচ্ছেন। জানা গেল নারদ নিউজ নামে একটি চ্যানেল দুবছর ধরে এই স্টিং অপারেশন চালিয়েছে। কিন্তু শুধুই কি তৃণমূলের নেতাদের হুল ফোটানো হয়েছে? তা-ই মনে হচ্ছে, কারণ নারদ কখনওই বলেনি যে তারা সব দলের নেতাদের কাছে গিয়েছে কিন্তু ফাঁদে পড়েছেন একমাত্র ওই দলের নেতারাই। তা হলে কি দলের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়েছে? দলের ভাবমূর্তিকে কর্দমাক্ত, কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হয়েছে? অন্তত তৃণমূল দল যে তা-ই ভাবছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, দল এই অপচেষ্টার মোকাবিলা করবে কী করে?

সেই হবুচন্দ্রের সময় থেকেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে আসছে মূলত দুই ভাবে। প্রথম পথ হল চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া, যাতে আর কখনও কেউ এ সাহস না পায়। কুচক্রীদের যদি পৃথিবী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা যায়, তা হলে তো আর সমস্যা থাকে না। দ্বিতীয় পথ হল দলের নেতা নেত্রীদের এমন ভাবে তৈরি করা যে কোনও কলঙ্ক যেন তাঁদের কোনও দিন স্পর্শ করতে না পারে— তাঁদের পায়ে একজোড়া নতুন জুতো পরিয়ে দেওয়া। কোন দল কোন পথে যাবে তা তারাই ঠিক করে। তৃণমূল আপাতত প্রথম পথই ধরেছে। একই ভাবে দেখছি তোলাবাজ, প্রোমোটার আর সিন্ডিকেটের মাথাদের জেলে পোরা হচ্ছে। এরাই তো কলুষিত করে পার্টিকে। রবীন্দ্রনাথ বুড়ো চর্মকারকে যে সম্মান দিয়েছিলেন আজকের রবীন্দ্রানুরাগীরা তা দিতে রাজী নন। আর মুখ্যমন্ত্রী হাওয়াই চটি ছাড়া কিছু পরেন না। জুতা আবিষ্কারে তাঁর উৎসাহ এমনিতেই কম।

কিন্তু সমস্যা তো শুধু দলের নয়, সমস্যা আমাদেরও। দুর্নীতি দমন আইন অনুযায়ী মন্ত্রী সান্ত্রিদের ঘুষ নেওয়া অপরাধ। তাই এ ধরনের ছবি প্রকাশ্যে এলে প্রশাসনের উচিত তদন্ত করা আর আদালতের কর্তব্য দোষীদের শাস্তি দেওয়া। অভিযোগ যেহেতু শাসক দলের বিরুদ্ধে তাই রাজ্য প্রশাসন এ কাজ করতে পারবে না— এই মর্মে উচ্চ আদালতে জনস্বার্থ-মামলা হয়েছে। মহামান্য আদালত বলেছেন প্রথমেই দেখতে হবে ছবির মধ্যে ভেজাল আছে কি না। এখনও কোনও অভিযুক্ত বলেননি, এ ছবি আমার না, আমার ঘরের দেওয়ালে বিবেকানন্দের ছবি আছে ভিডিয়োতে নেই, আমার টেবিলের ড্রয়ারগুলো অন্য দিকে, আমি বাড়িতে স্যুট পরে থাকি, বা সে-রকম কিছু। কিন্তু এমন কথা পরেও শোনা যেতে পারে তাই ভিডিয়োটি পরীক্ষা করা দরকার। আদালত এও বলেছেন যে ভিডিয়োটি নির্ভেজাল হলে যেমন বিপজ্জনক, ভেজাল থাকলেও তা-ই। খাঁটি কথা। তাই সবাই তাকিয়ে আছে সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরির দিকে।

ভিন্ন সময়ে তোলা ছবি জোড়া লাগালে কিছু তফাত থেকেই যায়। হয় আলোর পরিমাণ বা ক্যামেরার অ্যাঙ্গল হঠাৎ বদলে যায়, বা সাউন্ডট্র্যাক হঠাৎ উঁচুনিচু হয়ে যায়। এক কালে বিশেষজ্ঞরা দেখে বা শুনেই এই তফাত ধরে ফেলতেন। এখন সফটওয়ারের কারচুপি ধরতে লাগে আরও ভাল সফটওয়ার। তার সঙ্গে লাগে যন্ত্রপাতি। সরকারি ল্যাবে সে সবই আছে।

অন্য দিকে রাজ্য সরকার মনে করেছে চক্রান্তের ব্যাপারটি তদন্ত করে দেখা দরকার। কলকাতা পুলিশ এ জন্য একটি বিশেষ দল তৈরি করেছে। কাজ শুরু হয়েছে। এই সে দিন পুলিশ অফিসার মির্জাকে লালবাজারে পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশ কি নেতা নেত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে? তাঁরা চক্রান্তে জড়িত না থাকলে তার প্রয়োজন হবে না। ম্যাথু নাকি কোনও এক বিশেষ দিনে সাত বার দুবাইয়ে ফোন করেছিলেন। এই চাঞ্চল্যকর তথ্যের পরে কল লিস্ট থেকে আর কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। এ পাড়ার আব্দুল, ও পাড়ার গনজাল্ভেস, সে পাড়ার মোতি, সবাই যদি ম্যাথুকে সাহায্য করে থাকে তা নেহাত পয়সার লোভে। এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর নামও নাকি পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীরা একে অন্যের ‘ডিল’ করিয়ে দিতে সব সময়ে প্রস্তুত থাকে। সেটা বড় কথা নয়। এমন লোকের নাম পেতে হবে যিনি ম্যাথুর অভিসন্ধি জানতেন। আর যিনি টাকা জুগিয়েছেন? তিনি যদি দুবাইয়ের লোক হন, তাকে খুঁজতে ইডির সাহায্য চাই। তা কি পাওয়া যাবে?

কলকাতা পুলিশের তদন্ত আর উচ্চ আদালত যদি কোনও তদন্তের নির্দেশ দেন সেই তদন্ত, দুটোই কি একসঙ্গে চলতে পারবে? চলতে পারলে ভাল। যদি বিঘ্ন ঘটে, তা হলে আদালতই পথ বার করবেন। কোন তদন্ত অগ্রাধিকার পাবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে ফরেনসিক ল্যাবরেটরি কী বলে, তার ওপর।

ভূতপূর্ব মুখ্য সচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE