Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কিসে মানুষের উপকার হচ্ছে, সেটাই প্রশ্ন

মেয়েদের সক্ষম করা, লিঙ্গবৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো, এগুলো আমাদের লেখাপড়ার চত্বরে অনেক দিন ধরেই আলোচিত। এ বিষয়ে অনেক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে, হচ্ছে।

সক্ষমতা: মেয়েদের শিক্ষা জরুরি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটার মোকাবিলা করার জন্যও। দুর্গাপুর। নভেম্বর, ২০১৩

সক্ষমতা: মেয়েদের শিক্ষা জরুরি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটার মোকাবিলা করার জন্যও। দুর্গাপুর। নভেম্বর, ২০১৩

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৭ ০০:৪২
Share: Save:

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রদত্ত পুরস্কার পেলেন কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরের সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্পর্কে জানালেন বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিশিষ্ট মানুষদের। সেই সময়, কাকতালীয় ভাবে, নেদারল্যান্ডসের অদূরে জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নের অর্থনীতি পড়াচ্ছি। খবরটা পেয়ে খুশি হলাম, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হিসেবেই কেবল নয়, অর্থনীতির ছাত্র হিসেবেও, এবং উন্নয়নের অর্থনীতি পড়াই এবং সে সম্পর্কে কিছু গবেষণা করি বলেও।

গত ছ’বছরে এ রাজ্যে উন্নয়নের নানা কাজ হয়েছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুতের প্রসার, নতুন হাসপাতাল তৈরির চেষ্টা, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান, কন্যাশ্রী, অনাহারে মানুষের মৃত্যুকে রুখে দেওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা— নানা ধরনের কাজ হয়েছে, কোথাও কম বা কোথাও বেশি। কন্যাশ্রী প্রকল্পে মানুষ হাতেনাতে ফল পাচ্ছেন। শাসক দলের রাজনীতি সেই কারণেও খানিকটা সফল, এ কথা অতি বড় সমালোচকরাও স্বীকার করবেন।

মেয়েদের সক্ষম করা, লিঙ্গবৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো, এগুলো আমাদের লেখাপড়ার চত্বরে অনেক দিন ধরেই আলোচিত। এ বিষয়ে অনেক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে, হচ্ছে। এ কথাও বার বার প্রমাণিত যে, মায়েরা শিক্ষিত এবং সক্ষম না হলে শিশুদের বিকাশ হয় না। মেয়েদের শিক্ষা শুধু মায়েদের সক্ষম করার জন্য নয়, নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটার মুখোমুখি হওয়ার জন্যও। আশা করি, পঞ্চায়েত বা বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে কারণে ও অকারণে যে পরিমাণ গবেষণা হয়েছে, কন্যাশ্রী নিয়ে তার কিছুটা অন্তত পণ্ডিতেরা শুরু করবেন। কিছু গবেষণা চালুও হয়েছে, জানি। উন্নয়নের দর্শন নিয়ে বান্ডিল বান্ডিল তত্ত্ব এবং তথ্যে কিছুই হয় না। কী করলে মানুষের উপকার হবে, তার কথা বাদ দিয়ে আগে পড়া উচিত কী করলে মানুষের উপকার হচ্ছে, সেটা জানা।

উন্নয়নের অর্থনীতিতে যা নিয়ে সচরাচর কোনও আলোচনা কখনও হয় না, সেটা হল কোন নীতি কত তাড়াতাড়ি কার্যকর করা যায়, তার রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা এবং অবশ্যই আর্থিক খরচ। যিনি সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁকে কী কী ভাবতে হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া কিছু করা যায় না, রাজনৈতিক বাতাবরণকে উত্তপ্ত করে দিয়ে কিছু করা যায় না, বেশি দিন ধরে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করা যায় না, আর্থিক দুর্নীতিকে উপেক্ষা করা যায় না, অন্তর্ঘাত, আমলাদের নিষ্ক্রিয়তা, কর্মীদের অক্ষমতা, সব নিয়ে একটা নীতিকে কার্যকর করতে হয়। এটা হওয়া উচিত, ওটা হওয়া উচিত, রাষ্ট্র কেন এই করল না, সরকার কেন এটা করল না— এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রূপকথা বই কিছু নয়।

অনেকে বলেন এ রাজ্যে শাসনব্যবস্থা অত্যধিক কেন্দ্রীভূত। কতটা সত্যিই কেন্দ্রীভূত, সেটা জানতে হলে প্রক্রিয়াটির মধ্যে ঢুকতে হবে। সব বিষয়ে বলতে পারব না, কিন্তু বেশ কিছু দিন এই সরকারের বিশেষ কিছু কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাই বলছি। আমি নিজে দেখেছি, কোন দফতর উন্নয়নের কাজ কেমন করছে, বিশেষ করে বরাদ্দ টাকা ঠিক জায়গায় ঠিক খরচ হচ্ছে কি না, এটা নিয়ে একটা চার্ট তৈরি হত স্টেট প্ল্যানিং বোর্ডে। প্রতি মাসে মিটিংয়ের তথ্য সারিবদ্ধ ভাবে পাঠানো হত মন্ত্রিমণ্ডলের আলোচনা সভায়। সেই অনুযায়ী বেশ কঠোর পদক্ষেপ করা হত। এক অর্থে পরিকল্পনার প্রস্তাব তৈরি করার পাশাপাশি যতটুকু কাজ হচ্ছে, সেটা ঠিক হচ্ছে কি না, সেটা বুঝে নেওয়াও খুব জরুরি। প্রশাসনের কেন্দ্রীকরণ হয়েছে কর্মদক্ষ আমলাদের গুরুত্ব বাড়িয়ে, যে ভাবে পঞ্চায়েতেও খানিকটা পুনর্কেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এর দরকার ছিল। এ ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার রাজনৈতিক মৌরসি পাট্টায় আঘাত করে।

অনেক গভীর সংস্কারের কথা এক দিন নিশ্চয়ই লেখা হবে। সব নীতিই সমান সফল হবে না, সব জায়গায় সব কিছু কার্যকর হবে না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ লোকের কাছে পৌঁছে যাওয়া, সব জায়গায় উপস্থিত হওয়া, সেখানে গিয়ে কাজের খবর নেওয়া, এ সব যদি সর্বোচ্চ পদাধিকারী করতে পারেন, তা হলে নিজের নিজের জায়গায় সবাই কাজ করতে বাধ্য হন, সে সব জায়গার মানুষ বেশি সম্মান পাচ্ছে বলে ভাবেন, মনে করেন নালিশ করলে ফল পাওয়া যাবে। বিকেন্দ্রীকরণ মানে শুধু অধিকার রক্ষা নয়, নেতানেত্রীদের মানুষের কাছে যাওয়া। আর, মানতেই হবে, নেতা বা নেত্রী এক জন মানুষের কাছে পৌঁছলে সবাই নিজের লোক কাছে এসেছে বলে ভাবে। এর কোনও ফর্মুলা নেই। মানুষ রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে, মানুষের উপকার হলে মতবাদের পঞ্জিকা সে পড়ে না।

গবেষণার নৌকোয় আসমান-জমিন করে মানুষ আসলে যাকে উন্নয়ন ভাবে তার হদিশ পাওয়া যায় না। আমরা হামেশাই বলাবলি করি এই সরকারের বিভিন্ন ধরনের উৎসবের আয়োজন যদি কেইনস সাহেব দেখতেন, তা হলে গর্ত খুঁড়ে মাটি ভরাট করার বদলে তিনিও উৎসবের আয়োজন করতে বলতেন। কারণ, তিনি তখন বোঝেননি, উৎসবের ফলে মানুষ রাজনৈতিক শক্তির আরও কাছে আসে। কে কবে লোকশিল্পীদের ভাতা দিয়েছিলেন, বিশেষ করে প্রায় সবার জন্য? উৎসবকে কেন্দ্র করে বাজারের প্রসার হয়, বিনোদন শিল্পের সুবিধে হয়।

সরকারের নিশ্চয়ই অনেক সমস্যা আছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কিত ইত্যাদি। না-থাকলেই অবাক হতাম। কিন্তু এই ধরনের উন্নয়নের নীতি মানুষের উপকার করবে, রাজনৈতিক ভাবে বিপজ্জনক হবে না, অর্থনৈতিক সামঞ্জস্যকে বাঁচিয়ে লাগাতার বৌদ্ধিক উপেক্ষা এবং একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থেকেও ফলপ্রসূ হবে, তার একটা পথ এই সরকার এবং তার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে শিক্ষণীয়।

অনেকে বলতে পারেন, যে খরচ সরকার এখন বিভিন্ন খাতে করে, তাতে আরও ভাল কি কিছু করা যেত না? এর উত্তরে একটা গল্প বলে এই লেখা শেষ করি। এক জন বিপ্লবী-মার্কা গবেষক এক নামকরা জার্নালে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করার পর এক জায়গায় বক্তৃতায় বলে গেলেন, ভারতে যেখানে যেখানে জলাভাব, সেখানে যে ভাবে জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার সব জায়গায় গলদ, রাজনৈতিক দুর্নীতি আর নেতাদের দলবাজি। শুনে এক জন বললেন, ‘তা হলে কোন ব্যবস্থায় মানুষ জল পাবে আপনি বলে দিন।’ গবেষক উত্তরে বললেন, সেটা তাঁর গবেষণার অঙ্গ নয়।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE