ধানের বীজতলা ডুবে গিয়েছে, জলে-ডোবানো পাটের জাঁক ভেসেছে জলের তোড়ে, পচে শেষ সবজি, ডাল, ফুল, পান। বন্যার কবলে সাত লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি, ক্ষতি কয়েক হাজার কোটি টাকার। চাষির এই ক্ষতি পূরণ করবে কে?
কেন, বিমা কোম্পানি? ফসল বিমার জন্য তারা প্রিমিয়াম আদায় করে না বুঝি? পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একমাত্র রাজ্য, যেখানে ধানের বিমার জন্য এক পয়সাও প্রিমিয়াম দিতে হয় না চাষিকে। ২০১১-১২ সালের রবি (শীতের) ফসলের মরশুম থেকেই সে টাকাটা রাজ্য সরকারই দিয়ে এসেছে। তখন বিমার আওতায় ছিলেন দশ-বারো লক্ষ চাষি। গত বছর খরিফ (গ্রীষ্ম) মরশুমে বিমার আওতায় এসেছেন একত্রিশ লক্ষ চাষি। রাজ্যে মোট চাষির প্রায় অর্ধেক। যে চাষিরা কৃষিঋণ পান না, যাঁদের একটা বড় অংশ ভাগচাষি, ঠিকাচাষি, তাঁদেরও বিমার প্রিমিয়াম দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
ফসল বিমার বিস্তার বাড়ানোর আগ্রহ এখন গোটা দেশেই। আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাষের ঝুঁকি। চাষির বিপন্নতা রাজনীতিতেও ধাক্কা দিচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে কেন্দ্র ২০১৬ সালে শুরু করেছে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা।’ তাতে এক বছরে আরও ত্রিশ শতাংশ চাষি, বাড়তি ১৬ শতাংশ জমি এসেছে বিমার আওতায়। বিমার সংখ্যা অতি দ্রুত বেড়েছে যে রাজ্যগুলোতে, তার মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গও।
তবে কি চাষির দুর্ভাগ্যের কালো মেঘের কিনারায় রুপোলি রেখা দেখা যাচ্ছে?
সে ভরসা কম। ২০১৫ সালের জুলাইয়ের বন্যায় ভেসেছিল গোটা দক্ষিণবঙ্গ। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা দু’লক্ষ ত্রিশ হাজার চাষির। পেয়েছেন কত জন? এক জনও নন। ২০১৬ সালের খরিফের জন্য ১১৯ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল রাজ্য। মিলল কত? মাত্র ৯৩ হাজার টাকা। সে বছর ছত্তীসগঢ় ১৪৩ কোটি টাকার আবেদন করে এক টাকাও পায়নি, গুজরাত ৩২৪ কোটি টাকার এক শতাংশ পেয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্র এই হিসেব পেশ করেছে রাজ্যসভায়। কেন এই দশা? বিমা সংস্থাগুলোর দাবি, রাজ্য সরকারগুলি তাদের প্রদেয় ভরতুকি দেয়নি, উৎপাদনের তথ্যও দেয়নি। তাই ক্লেম পাশ হচ্ছে না। সিএজি-ও একটি রিপোর্টে বলেছে, দেরি হচ্ছে রাজ্যদের গড়িমসিতে।
কেন্দ্র বা রাজ্য, যে-ই দায়ী হোক, চাষির সান্ত্বনা নেই। তার চোখে ফসল বিমা আরও একটা সরকারি প্রকল্প, যা কথা রাখে না। পশ্চিমবঙ্গ ধান্যব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রফিক আলি বললেন, ‘আমাদের পঁয়ত্রিশ হাজার সদস্য, প্রায় সকলে নিজেরা চাষ করেন। বিমার ক্লেম পেয়েছেন, এমন কারওকে চিনি না।’ ধারণাটা অবশ্য সম্পূর্ণ ঠিক নয়। সমবায় ব্যাংকের কর্তাদের মতে, গড়ে বছরে লাখ দুয়েক চাষি ক্লেম পান, যদিও ব্যাংক সেটা তাঁদের কৃষিঋণের সঙ্গে ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নেয় বলে চাষিরা টের পান না। কিন্তু টাকা যে আসে ক্লেম করার দু-তিন বছর পর, তাতে বিমার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়।
তাই ফসল বিমায় চাষির আস্থা নেই। ২০১৫ সালে এ রাজ্যে খরিফ ধানের বিমা হয়েছিল দশ লক্ষ চাষির (ধানে প্রিমিয়াম ফ্রি!), যেখানে পাট বিমা করিয়েছেন মাত্র ৬৪ হাজার চাষি। যদিও অন্তত ৩০ লক্ষ চাষি পাট চাষ করেন। এই জন্যই চাষি ঋণ মকুবের দাবি করেন, কিন্তু দ্রুত ক্লেম আদায়ের দাবি করেন না। তাতে চাষির যেমন ক্ষতি, তেমনই করদাতারও। কারণ বিমার বিস্তার যত বাড়ছে, তত বাড়ছে প্রিমিয়াম। ২০১২-১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষিবিমার প্রিমিয়াম দিয়েছে চল্লিশ কোটি টাকা, যা ছিল কৃষি বাজেটের চার শতাংশ।
২০১৬-১৭ সালে দিয়েছে চারশো চল্লিশ কোটি টাকা, যা ১৯ শতাংশ। বিমার প্রিমিয়াম বিহারের কৃষি বাজেটের ২৫ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৬০ শতাংশ। চাষির যদি লাভ না হয়, তা হলে বিমার বিস্তার বাড়া মানে শুধু অপচয় বৃদ্ধি।
বিমার টাকা মিলবে না ধরে নিয়ে অন্য সহায়তারও দাবি ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে স্টেট ডিজাস্টার রিলিফ ফান্ড থেকে প্রতি হেক্টরে সাড়ে তেরো হাজার টাকা হিসেবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় চাষিকে। ২০১৫ সালে স্টেট ডিজাস্টার রিলিফ ফান্ড থেকে ১২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল ৩০ লক্ষ চাষিকে। সে বছর সরকার ফসল বিমার প্রিমিয়াম দিয়েছিল ১৮৫ কোটি টাকা। সে বছরের ক্লেম আজও মেলেনি।
এ বছর ফের রিলিফ ফান্ডের টাকা বিলি হবে।
বেসরকারি সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর একটি রিপোর্ট বলছে, প্রিমিয়ামের বিপুল অঙ্ক পেয়ে মোটা হচ্ছে বিমা কোম্পানি, শুকিয়ে মরছে চাষি। ২০১৬ সালে ছয় হাজারেরও বেশি চাষি আত্মহত্যা করেছেন। ওই বছরই কৃষি বিমা সংস্থাগুলি লাভ করেছে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। প্রধানত কৃষি বিমার প্রিমিয়ামের জন্যই জেনারেল ইনশিওরেন্স ক্ষেত্রে এক বছরে প্রায় বত্রিশ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে, বলছে ওই রিপোর্ট। সম্প্রতি সিএসই-আয়োজিত সভায় কৃষক নেতা কেদার সিরোহি বলেন, টাকাটা বিমা সংস্থাদের না দিয়ে চাষিদের দিলেই পারে সরকার। বিশেষজ্ঞরা এ কথা উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু চাষির জন্য বরাদ্দ টাকা যে চাষির কাজে লাগে না, এই আক্ষেপটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কেন ফসল বিমা কাজে লাগছে না চাষির?
তার এক প্রধান কারণ, চাষে কত ক্ষতি হল, তার জরিপ হচ্ছে আদ্যিকালের পদ্ধতিতে। ভারত মহাকাশে উপগ্রহ পাঠাচ্ছে, অথচ চাষের খেতে ক্ষতির পরিমাণ বুঝতে স্যাটেলাইট বা ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে না। এ সব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি পাইলট হয়েছে, সফলও হয়েছে। এমনকী কত ক্ষতি হতে চলেছে, আগাম বলে দিচ্ছে প্রযুক্তি। কিন্তু কাজের বেলা মাঠে পাঠানো হয় কৃষি দফতর আর বিমা কর্মীদের। কখনও ব্লক, কখনও গ্রাম পঞ্চায়েতকে ‘ইউনিট’ ধরে উৎপন্ন ফসলের পরিমাণের নমুনা নেন তাঁরা। অভিযোগ, কোনও জরিপ হয় না, ক্ষতির অঙ্ক লেখা হয় ঘরে বসে। বিমার বিস্তার দ্রুত বেড়েছে, অথচ কোনও রাজ্য কৃষি দফতরে বাড়তি কর্মী নেয়নি। বিমা কোম্পানিরাও তথৈবচ। ফলে ক্ষতির পরিমাপ স্বচ্ছ, দ্রুত হচ্ছে না। ক্লেম মিলবে কী করে?
চাষির অভিযোগ, বিমার অধীনে থাকে মাত্র কয়েকটি ফসল। পশ্চিমবঙ্গে যেমন এ বার খরিফ মরশুমে কেবল চারটি ফসলের (আমন ও আউস ধান, পাট ও ভুট্টা) বিমা হচ্ছে। অথচ বর্ষার পেঁয়াজ-সহ নানা শাকসবজি, পান, তিল, তিসি, সবুজ মুগ, ফুল, কলার মতো ফল, সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। কেদার সিরোহির বক্তব্য, ‘ভারতের যে কোনও জেলায় অন্তত পঞ্চান্ন রকম ফসল ফলে, অথচ পাঁচ-সাতটার বেশি ফসলের বিমা হয় না।’ মজা হল, বিকল্প ফসল, মিশ্র ফসল করতে উৎসাহ দেয় সরকার, কিন্তু বিমা হয় সাবেক চাষের নকশা ধরে। বিমার খাতায় ক্ষতির স্বীকৃত কারণও হাতে-গোনা। হাতি, শুয়োরের আক্রমণে, আগুন বা হিমে ফসল নষ্ট হলে কিছুই মিলবে না।
চাষি বিমার টাকা না পেলে সব রাজ্য সরকারেরই ক্ষতি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু কৃষিঋণের গ্রাহক এবং অ-গ্রাহক, সব চাষির ধানের বিমার সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম দেয়, তাই এক দৃষ্টিতে
এ রাজ্যে সরকারের দায় বেশি। অন্য দিকে, ঋণের অ-গ্রাহক চাষি যেহেতু বিমার টাকা সরাসরি অ্যাকাউন্টে পাবেন, তাই ক্লেম সময়মত মিললে শাসকদলের লাভও কম নয়।
চাষির স্বার্থ আর রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সহজে মেলে না। ফসল বিমায় এ দুটো মিলে যাচ্ছে। চাষির ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy