Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ট্রাম্প এলেন কেন, সেটাই প্রশ্ন

ট্রা ম্প সাহেবের অভিবাসন নীতি নিয়ে গোটা বিশ্ব তোলপাড়। যে দেশটা বাইরে থেকে আসা মানুষকে নিয়েই এত দিন প্রগতির পথে এগিয়েছে, তার আজ হল কী? গোটা দুনিয়া এককণ্ঠে ‘ছি, ছি’ করছে, মার্কিন আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ট্রা ম্প সাহেবের অভিবাসন নীতি নিয়ে গোটা বিশ্ব তোলপাড়। যে দেশটা বাইরে থেকে আসা মানুষকে নিয়েই এত দিন প্রগতির পথে এগিয়েছে, তার আজ হল কী? গোটা দুনিয়া এককণ্ঠে ‘ছি, ছি’ করছে, মার্কিন আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু, গোটাকয়েক ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ কথা না বলেও পারছি না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর যত খুশি চটুন, কিন্তু দোহাই, বাস্তব অবস্থার কথাটাও ভুলবেন না।

ট্রাম্প একেবারে আইনানুগ ভাবে মানুষের ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এবং, তিনি নির্বাচনের প্রচারপর্বে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন। তিনি এখন নিজের প্রতিশ্রুতিগুলোকে দ্রুত নীতিতে পরিণত করতে চাইছেন মাত্র। কাজেই, যতই কষ্ট হোক না কেন, মানতেই হবে, ট্রাম্প যা করছেন, সে দেশের মানুষের একটা বড় অংশ সেগুলোই চায়। তিনি সেই জনতার প্রতিভূ।

ট্রাম্প একটা কথা সার বুঝেছেন— গত তিন দশক ধরে ক্রমবর্ধমান অসাম্য, স্বল্প মজুরির কাজে প্রবল প্রতিযোগিতা এবং গোটা দেশটা দৃশ্যত বিদেশি মানুষে ভরে যাওয়া সাধারণ মার্কিন নাগরিককে রাগিয়ে দিয়েছে। তাঁরা সমস্ত উদারনৈতিক চিন্তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই যদি বিদেশি নাগরিকরা কাজ পেয়ে চলতে থাকে, যে কোনও দেশের মানুষই কি তাতে চটবেন না? অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে অনেক রকম যুক্তিই খাড়া করা যায়, কিন্তু রেগে থাকা সাধারণ মার্কিন নাগরিক কোনও যুক্তি মানছেন না। ফলে, ট্রাম্প আরও জাঁকিয়ে বসেছেন।

নব্বইয়ের দশকে জার্মানিতে পড়াতে শুরু করেছি। ট্রেনে উঠলেই দেখতে পেতাম শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থীদের। সবাই নাকি এলটিটিই-র সভ্য। আমার চেহারাটা আবার খানিক তামিল-মার্কা! ফলে, তাঁরা আমার কাছে অকপটে বলতেন— তাঁরা কেউই বিপ্লব করেননি। নিজের পাসপোর্টটা নষ্ট করে সুইটজারল্যান্ডে ঢুকে বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার সরকারের অত্যাচারে পালিয়ে এসেছি’— সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি।

১৯৯২ সালে আমেরিকার রচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে গেছি। আমি দেশে ফিরে যাব শুনে আমার এক ছাত্রের কাকা অকৃত্রিম বিস্ময়ে জানতে চাইলেন, ও দেশেই থেকে যাব না কেন? জানালেন, আমি যদি চাই, তিনি আমায় টেক্সাসের এক কৃষিখামারে বে-আইনি শ্রমিক করে রেখে দেবেন! পরে একটা গ্যাস স্টেশনে আইন মেনে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি অধ্যাপনা করি, এবং দেশেই ফিরে যেতে চাই শুনে তিনি প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন!

কাজের সূত্রে যাঁরা প্রায়শই ইউরোপে যান, তাঁরা জানেন যে বিভিন্ন এয়ারপোর্টে ‘শরণার্থী’দের দেখে অনেক সময়ই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যুযুধান সিরিয়া বা দুর্ভিক্ষপীড়িত সুদানের মানুষদের টেলিভিশনের পর্দায় দেখে মোটেও ভাববেন না যে শরণার্থী শুধু এঁরাই। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের রেশন কার্ড বিলি করে ভোটারের সংখ্যা বাড়ানোর গল্পটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে আর নতুন করে কী বলব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একেবারে কায়িক শ্রমের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা সে দেশের নিম্নবিত্তদের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিকে তাঁরা দেখছেন, উচ্চবিত্ত মানুষ বিপুল বৈভবের জীবন কাটাচ্ছেন। রাজনীতির স্রোত এই বিপুল বৈষম্যের খাত বেয়ে গড়াবেই। গড়িয়েছেও বটে। যাঁরা এখন শরণার্থীদের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন, ডেমোক্র্যাট জমানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আয়বৈষম্যের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে তাঁদের মধ্যে ক’জন মুখ খুলেছিলেন? ক’জন বলেছিলেন, শিল্প এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সীমাহীন খরচ অবিবেচনার কাজ হচ্ছে?

ট্রাম্প যা করছেন তা ভাল না খারাপ, তা নিয়ে আলোচনা চলবে। ভাল-মন্দের বিচার চিরকালই আপেক্ষিক। কিন্তু, এটা হওয়ারই ছিল। অর্থনীতির যুক্তি বলবে, এই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি শেষ অবধি সে দেশের অর্থনীতিকে দুর্বলই করবে। মার্কিন সংস্থাগুলো যদি সত্যিই বিদেশ ও বিদেশি-নির্ভর বাণিজ্য থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়, তা হলে অন্য দেশের সংস্থাগুলি অনেক বেশি জায়গা পেয়ে যাবে। আবার, এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে অভিবাসীরা মার্কিন মুলুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে— তাঁদের কর্মক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা থেকে দেশেরও লাভ হয়েছে ঢের। বে-আইনি শ্রমিকের কম মজুরি, তাঁদের যখন-তখন ছাঁটাই করার অবাধ স্বাধীনতায় মুনাফা বেড়েছে। অভিবাসীদের সাফল্যে স্থানীয় মানুষের গোঁসা হয়েছে। কিন্তু, কার্য-কারণ বিবেচনা না করেই সেই গোঁসাকে শিরোধার্য করে নীতি প্রণয়ন করলে তার ফল বিষম হওয়াই স্বাভাবিক। ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই বিপদ তৈরি করে ফেলেছেন।

তবে, ট্রাম্প বা তাঁর সমর্থকদের এত হাত নেওয়ার আগে ভেবে দেখা ভাল, এই ধরনের মানসিকতার জন্ম কেন হয়? কী ভাবে ক্রমে তার শিকড় গভীরতর হয়? নিরপেক্ষ ভাবে ভাবলে অনেকের ব্যর্থতাই স্পষ্ট হবে। ভারতেও যেমন। স্বাধীনতা অর্জনের পর যে গোত্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক মতবাদের কোনও স্বীকৃতিই ছিল না, ধীরে ধীরে সেই দর্শনই মানুষের রায়ে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গেল। এক জনের সাফল্য চির কালই অন্য কারও ব্যর্থতার প্রতীক। সাফল্যের রসায়ন বিশ্লেষণ করার সময় সেই ব্যর্থতার ব্যবচ্ছেদ করাও বাঞ্ছনীয়।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE