নারীত্ব লইয়া সমাজের সমস্যার অন্ত নাই। সমাজে হউক বা গৃহে, মাতৃত্বে হউক বা নেতৃত্বে, রাজনীতিতে হউক বা কর্মক্ষেত্রে— নারী যেমনই থাকুক, যাহাই করুক, সমাজ তাহার ত্রুটি বাহির করিবেই। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার এক কর্মী অফিসের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে লিখিয়াছিলেন, মহিলারা স্বভাবগত ভাবে অত্যন্ত ভঙ্গুর, অত্যধিক চাপ তাঁহারা সহ্য করিতে পারেন না, অথচ আইটি-র দুনিয়ায় প্রবল চাপে কাজ করিতে হয়, সুতরাং তাঁহারা সেই দুনিয়ায় পুরুষের সমকক্ষ হইতে পারেন না, অতএব কর্তৃপক্ষ সংস্থায় নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সব ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহা অন্যায়। সংস্থাটি তাহাদের নীতির পরিপন্থী এই মত প্রকাশের অপরাধে ওই কর্মীকে বরখাস্ত করিয়াছে। তিনিও নাকি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আইনের পথ অনুসরণের কথা ভাবিতেছেন।
সংস্থাটি ও তাহার কর্মী এই বিবাদের মীমাংসা কী রূপে করিবে, তাহা এখানে বিচার্য নহে। কিন্তু সেই বিবাদ হইতে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন উঠিয়া আসে। প্রশ্নটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। ঘটনা হইল, নারীরা যে পরিমাণ চাপ আপন জীবনে সহ্য করেন, বিশেষত যে পারিবারিক ও সামাজিক অসাম্যের চাপ সহিয়া বহু নারীকে নিত্য জীবন চালাইতে হয়, তাহা অধিকাংশ পুরুষের অকল্পনীয়। কেবল যদি কর্মক্ষেত্রের গণ্ডিতে নারীদের বিচার করা হয় এবং দাবি করা হয় কর্মক্ষেত্রে তাঁহারা চাপ সহ্য করিতে পারেন না, তবে প্রশ্ন উঠিবে, কর্মক্ষেত্রে চাপ সহ্য করিবার মতো সুযোগ কি নারীদের দেওয়া হইয়াছে? পুরুষের সমান সুযোগ? যেমন, এক বা একাধিক শিশুসন্তানের জননীকে গৃহে সন্তান পালনের চাপ হইতে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে কি, যাহাতে তিনি মুক্ত-চিত্তে কর্মক্ষেত্রের চাপ সামলাইতে পারেন? যদি কোথাও কাহাকেও সেই সুযোগ দেওয়া হইয়া থাকে, তবে তাহা কোটিকে গুটিক। সমাজের বড় চিত্রটি আজও বদলায় নাই।
বড় চিত্র বদলাইবার চেষ্টাও বড় আকারেই করা আবশ্যক। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার মোকাবিলা করিতে চাহিলে তাহার কণ্ঠস্বরকে দমন করিলে চলিবে না, বরং তাহার প্রকাশের পথ উন্মুক্ত করিতে হইবে। পিতৃতন্ত্র তাহার যুক্তি বলিবে, ইহাই স্বাভাবিক। সেই যুক্তির সার্থক ও জোরদার প্রতিযুক্তি সন্ধান করিয়াই তাহার সহিত যথার্থ লড়াই সম্ভব। স্পষ্টতই, তাহার জন্য প্রয়োজন বাকস্বাধীনতার অধিকার। কোনও ব্যক্তি যদি নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস না করেন এবং বিরুদ্ধমত প্রকাশ করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে বাতিল করিলে এই সমস্যার সমাধান হইবে না। কারণ সমস্যা নির্মূল করিবার অর্থ, তাহার মূলে গিয়ে সমস্যাকে বিনষ্ট করা। ব্যাধি হইয়াছে বলিয়া যদি বহু মানুষকে পরিত্যাগ করা হয়, তবে ব্যাধির মোকাবিলা করা যাইবে না। অনেক বেশি কার্যকর ব্যাধির কারণ জানিয়া, তাহার প্রতিষেধক খুঁজিয়া বার করা। অনেক সময়েই তাহা কঠিন কাজ। পিতৃতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিকেও যুক্তি-তর্ক দিয়া অসাম্য হইতে সাম্যের পথে আনা সহজ নহে। কারণ তাহার পিছনে আছে বহু যুগের মননের অভ্যাস। কিন্তু চেষ্টা চালাইতেই হইবে, অন্য পথ নাই। এবং, পিতৃতন্ত্রের মন কালে কালে একেবারে বদলায় নাই বলিলে ভুল হইবে। বদল চলিতেছে। হাল ছাড়িবার প্রশ্ন নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy