Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

সর্বময়

আন্তর্জাতিক বিশ্বে কোনও দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যদি সে-দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক মুক্তির অভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহার ফল ভয়ানক হইতে পারে।

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৮ ০১:২০
Share: Save:

স‌ম্রাট শি চিনফিং-এর নব-অভিষেক অনুষ্ঠান— গত বৎসরে চিনা রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট হিসাবে যখন তাঁহার মেয়াদ আরও পাঁচ বৎসর বাড়ে, তখনই সেই অনুষ্ঠানকে এ ভাবে বর্ণনা করিয়াছিল নানা দেশের নানা প্রচারমাধ্যম। বর্ণনার মধ্যে যে অতিরঞ্জন ছিল না, এই বৎসর প্রেসিডেন্টের কার্যকাল সম্বন্ধীয় সংশোধনী প্রস্তাব ঘোষণার মধ্য দিয়া তাহা প্রমাণিত হইল। এত দিনের সাংবিধানিক রীতিনীতি প্রেসিডেন্ট পালটাইয়া দিলেন, প্রেসিডেন্টের সবসুদ্ধ দুইটি পাঁচ বৎসরের মেয়াদের বদলে স্থির হইল যে প্রেসিডেন্ট অনির্দিষ্ট কাল, অর্থাৎ আজীবন কাল, ক্ষমতায় থাকিতে পারিবেন। শি চিনফিং বুঝাইয়া দিলেন, মাও জে দংয়ের পর তিনিই চিনের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন নেতা। এবং সার্বিক বিচারে, তিনি চিনের সর্বকালের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন নেতা, কেননা এই মুহূর্তে দুনিয়ায় চিনের যে অর্থনৈতিক দাপট, আগে কখনওই তাহা ঘটে নাই, ফলে চিনের নেতা দুনিয়ার নেতা— এমন বলিবার অবকাশও আগে কখনও আসে নাই। এই মুহূর্তে বিশ্ব-অর্থনীতির দ্বিতীয় প্রধান পুরুষ তিনি, এমন বলিলে ভুল হইবে না। চিনকে লইয়া তাঁহার এখন বিরাট উচ্চাশা, দক্ষিণ চিন সমুদ্রের নৌবহরের রাশ হইতে শুরু করিয়া এশিয়া মহাদেশব্যাপী ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পের সমারোহ শি চিনফিং-এর চিনকে এখন অভূতপূর্ব আন্তর্জাতিক প্রোফাইলের অধিকারী করিয়াছে। আগে কখনও চিনকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে প্রাধান্য পাইতে এতখানি উদগ্রীবতা লইয়া লড়িতে দেখা যায় নাই। এই নূতন প্রোফাইলের এক ও একমাত্র নির্মাতা শি। এ বার তিনি দেশের তথা নিজের এই প্রোফাইলটিকে আজীবন রক্ষা করিবার সিদ্ধান্ত লইলেন।

সিদ্ধান্তটি নানা অর্থে ঐতিহাসিক। একেবারে গোড়ার দিন হইতে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি একটি বিশেষ আদর্শে স্থির ছিল, ১৯৪৯ সালে পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাও একই আদর্শের উপর ভর করিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়: পার্টি এবং সরকার সর্বদা সামূহিক ভিত্তিতে তৈরি হইবে, জনসাধারণের জন্য ও জনসাধারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইবে, কোনও ব্যক্তিগত উত্তরাধিকারকে প্রশ্রয় দিবে না। এই আদর্শটি অনেক সময়ে ব্যাহত হইয়াছে নিশ্চয়ই, কিন্তু আদর্শ হিসাবে তাহা কখনও পরিত্যক্ত হয় নাই। শি কিন্তু সোজাসুজি আদর্শটিকেই পালটাইয়া দিলেন। এবং তাহা সংবিধানে বিধৃত করিলেন। বাস্তবিক, রিপাবলিক গঠনের পর হইতে এই ভাবে আর কোনও প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক ভাবনা নূতন ভাবে চিনা সংবিধানের অংশীভূত হয় নাই। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে আকস্মিক বলা যাইবে না। দ্বিতীয় বার পাঁচ বৎসরের জন্য ক্ষমতা হাতে লওয়া ইস্তকই শি এই অভিমুখে অগ্রসর হইতেছেন, দ্রুত ক্ষমতার প্রসারণ ঘটাইতেছেন। একেই তো কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতান্ধ আচরণে সে-দেশে পার্টির বাহিরের মতামত ও দৃষ্টিকোণগুলি ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ। বুদ্ধিজীবীরা এখন নিজেদের মতামত পার্টির ভয়ে বাহিরে প্রকাশ করেন না। তদুপরি পার্টির ভিতরেও মতামত-আলোচনার অবকাশ বন্ধ করিয়া দিল প্রেসিডেন্ট শি-র উদ্ধত ঘোষণা।

ভাবনা কেবল চিনকে লইয়া নহে। বহির্বিশ্বেরও দুশ্চিন্তার কারণ আছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে কোনও দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যদি সে-দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক মুক্তির অভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহার ফল ভয়ানক হইতে পারে। আশঙ্কার কারণ আছে যে, চিনে এ বার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একচ্ছত্র নেতার অনুগমন ও পদলেহন চলিতে থাকিবে, এবং বিশ্ব-রাজনীতিতে চিনের প্রশ্নহীন ক্ষমতাবিস্তারে ক্রমে ভারসাম্যের অভাব ঘটিতে থাকিবে। যে প্রেসিডেন্ট দেশের ভিতরে মুক্তিতে বিশ্বাস করেন না, দেশের বাহিরে তিনি ক্ষমতার ভারসাম্যে আস্থা রাখিবেন, এমন ভাবিবার কারণ আছে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Xi Jinping China President
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE