Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

শাস্তি

মোদী সরকার বিশেষ ভাবে কৃষকদের প্রতি বঞ্চনা করিতেছে বলিয়া কৃষিজীবীরা ক্ষুব্ধ হইতে পারেন। কিন্তু বঞ্চনার মূল প্রোথিত ব্যাপকতর ব্যর্থতায়।

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০৮
Share: Save:

কান ধরিয়া এক পায়ে দাঁড়াইবার ভঙ্গিটি যোগাসনের তালিকায় স্থান পাইয়াছে কি না, জানা নাই। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস বৃহস্পতিবার সেই রূপে দাঁড়াইয়া তাঁহারই দলের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীকে ফোন করিয়াছিলেন কি না, তাহাও জানা যায় নাই। কিন্তু অশীতিপর যশবন্ত সিন্‌হা ভারতীয় জনতা পার্টিকে শাস্তিপ্রাপ্ত বালকদের অবস্থানে দাঁড় করাইলেন। সরকার-বিরোধী কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়া তিনি কৃষকদের দাবিগুলি আদায় করিয়াছেন। অর্থাৎ কৃষকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে দলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাতে ফেল করিল বিজেপি। দলের কৃষক সংগঠনও প্রতিশ্রুতি না রাখিবার জন্য কেন্দ্রের নেতাদের দুষিতেছে। যেমন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অঙ্কটি ফসলের উৎপাদন খরচের দেড় গুণ ধার্য করিবার নির্বাচনী ঘোষণা তিন বৎসরেও কাজে পরিণত হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী সেচ পরিকল্পনার অধীনে তেইশটি প্রধান সেচ প্রকল্প গ্রহণ করা হইয়াছিল, তিন বৎসরে সেগুলিরও তেমন অগ্রগতি হয় নাই। মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষার কার্ড কিছু চাষির হাতে পৌঁছাইয়াছে, কিন্তু সারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করিয়া কৃষির ব্যয় কমাইবার লক্ষ্য বহু দূরে। প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনাটিও তিন বৎসর পার করিয়াছে। বিমা কোম্পানিগুলির লাভ বহু গুণ বাড়িলেও, কৃষকের নিরাপত্তা বাড়ে নাই। অতি বিলম্বে, অতি সামান্য ক্ষতিপূরণ পাইবার ধারাটি পূর্ববৎ চলিতেছে। অতঃপর, মহারাষ্ট্রে বিমা কোম্পানিকে প্রিমিয়াম গনিয়া দেওয়ার পরে ফের নষ্ট তুলা ও ডালশস্যের সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অঙ্গীকার করিল রাজ্য সরকার।

মোদী সরকার বিশেষ ভাবে কৃষকদের প্রতি বঞ্চনা করিতেছে বলিয়া কৃষিজীবীরা ক্ষুব্ধ হইতে পারেন। কিন্তু বঞ্চনার মূল প্রোথিত ব্যাপকতর ব্যর্থতায়। ভারতে জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কৃষির উপর নির্ভরশীল, অথচ কৃষি এবং সামগ্রিক ভাবে গ্রামীণ উৎপাদনের ভাগ জাতীয় উৎপাদনের এক পঞ্চমাংশও নহে। যাহার অর্থ, প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ব্যক্তি কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত রহিয়াছেন। শিল্পে নিয়োগ বাড়িলে কৃষি-নির্ভরতা কমিত। তাহা হয় নাই। বরং নোট বাতিলের ফলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, অর্থাৎ ভারতে উৎপাদন বাড়াইবার পরিকল্পনা, অথবা ‘স্কিল ইন্ডিয়া’, অর্থাৎ তরুণতরুণীদের দক্ষতা তৈরি করিয়া তাহাদের নিয়োগ বাড়াইবার প্রকল্প, দুটিই এখনও অবধি প্রতিশ্রুতি হইয়া রহিয়াছে। কৃষকদের মাসিক অনুদানের দাবি ইঙ্গিত করিতেছে যে গ্রামীণ পরিবারগুলি তাহাদের ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করিবার প্রতিশ্রুতি খুঁজিতেছে। সমৃদ্ধি নহে, আত্মহত্যা এড়াইবার পথ খুঁজিতেছে তারা।

কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন আনিতে বিজেপির ব্যর্থতা দলের উপেক্ষিত প্রবীণ নেতা যশবন্ত সিন্হাকে ফের প্রচারের আলোয় আনিল। ইহা রাজনীতির কৌতুক। কিন্তু রাজনীতির দাবি মানিয়া এক প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যে অবস্থান লইলেন, অর্থনীতির দৃষ্টিতে তাহার যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। কৃষিঋণ মকুব, নষ্ট ফসলের সম্পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, সহায়ক মূল্যে সম্পূর্ণ কৃষি উৎপাদনের সরকারি ক্রয় ও তাহার বিপণন, সার-কীটনাশক-বিদ্যুতে ভরতুকি বৃদ্ধি, প্রতিটি কৃষক পরিবারকে মাসিক ভাতা প্রদান, কৃষক আন্দোলনের এই সকল দাবি রাজকোষের বোঝা কী পরিমাণে বাড়াইবে, দেশের আর্থিক বৃদ্ধিতে তাহার কী প্রভাব পড়িবে, তাহা বুঝিতে এক প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এবং এক বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ভুল হইবার কথা নহে। তবু এক জন দাবি তুলিলেন, অপর জন তাহা মানিলেন। ভ্রান্ত, অর্ধ-রূপায়িত নীতি এমন ভাবেই রাজনীতিকে পথভ্রষ্ট করে, এবং সেই রাজনীতি আসিয়া অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞানকেও লইয়া যায়। তাহার দায় বহন করিয়া চলা ভিন্ন রাজকোষের আর কোনও উপায় থাকে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE