স্বয়ং যোগী আদিত্যনাথ যে এমন করিয়া সংঘকে বিপদে ফেলিবেন, প্রত্যাশিত ছিল না। তাঁহার প্রস্তাবিত লখনউ শহরের রামায়ণ মেলার কথা শুনিয়া ইস্তক সংঘ নিশ্চয় বিষম অশান্তিতে ভুগিতেছে: তুমিও, ব্রুটাস? রামায়ণ যে বহু নয়, অনেক নয়, মাত্র এক ও একক, সুতরাং রামও যে অদ্বিতীয় চরিত্র— এত করিয়া এই বাণী প্রচার ও প্রসারের পর এখন বিজেপির সর্বাপেক্ষা কড়া হিন্দুত্ব-নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রীর তরফেই ‘নানা রামায়ণ’-এর উদ্যাপন? যোগীর উদ্দেশ্যটি অবশ্য অত্যন্ত ‘সংঘবাদী’, সামনে কিছু উপনির্বাচন আসিতেছে দেখিয়া তিনি উত্তরপ্রদেশে হিন্দুত্ববাদের জোয়ার আনিতে সচেষ্ট হইয়াছেন, রামায়ণের মাধ্যমে ভোটের বাজার গরম করিবার প্রয়াস করিতেছেন। আসিয়ান-ভুক্ত দশটি দেশের রামায়ণের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে দেখাইতে চাহিতেছেন, রামায়ণের আবেদন কত দুর্মর, কত বিস্তৃত তাহার গরিমা ও মহিমা। মাঝখান হইতে কাল হইয়া গিয়াছে, অন্যান্য দেশের রামায়ণ আখ্যানগুলির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকায়। বিভিন্ন দেশের রামায়ণে কেবল পার্শ্বিক আখ্যানগুলি বিভিন্ন প্রকার নহে, অনেক সময়ে মূল আখ্যানটিও মৌলিক ভাবে আলাদা। এই যেমন কম্বোডিয়ার মতো দেশে বৌদ্ধ-ভাবাপন্ন রামায়ণ ঐতিহ্যে সীতা রামের সম্পর্কটিও বৈবাহিক নহে। যোগী কি ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে কিছু কাল আগেও এ কে রামানুজন নামক প্রখ্যাত কন্নড় লেখককে কত হেনস্তা পোহাইতে হইয়াছিল এই সামান্য কথাটি লইয়া বই লিখিয়া তাহার নাম ‘থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণস’ রাখার কারণে?
সংঘের এই সাম্প্রতিক অশান্তির সংবাদ শুনিয়া মনে পড়ে, সুদূর চতুর্দশ শতকেও রামায়ণের বহুত্ব লইয়া কবি-সাহিত্যিকদের কত ঝামেলায় পড়িতে হইত। কুমারব্যাস নামে তৎকালীন কন্নড় কবি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাঁহার মহাভারত-আশ্রিত কাব্যগ্রন্থ লেখার নেপথ্য কারণটি: রামায়ণ লইয়া লিখিবার কথা ভাবিলেই তিনি শুনিতে পান, ভুবনজোড়া রামায়ণ-লিখিয়ে’দের ভারের তলায় চাপা পড়িয়া মহাকাল-সর্পরাজ অবরুদ্ধ যন্ত্রণায় দিবারাত্রি নিষ্কৃতি কামনায় আর্তনাদ করিতেছেন! আসিয়ান অবধি যাইবার কী দরকার, বাল্মীকির রামায়ণ ও তামিল রামায়ণই যদি পাশাপাশি রাখিয়া তুলনামূলক আলোচনা হয়, সংঘকর্তারা শিহরিয়া উঠিয়া তামিল সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়া দিবেন।
বহুত্ববাদ আটকাইবার প্রকল্পটি এই কারণেই বড় ঝামেলার। ভারতের মতো দেশে অকস্মাৎ কোথায়, কোনখানে যে তাহার পরশ আসিয়া উপস্থিত হয়, কে জানে! এত রকম ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির ঘা কি একটি সংঘ দিয়া ঠেকানো যায়। যোগীর তাই এখন মহা দুশ্চিন্তা, যে সভার আয়োজন তিনি করিয়াছেন, তাহা বাতিল করা ভাল দেখায় না, কিন্তু আরএসএস নির্দেশ অনুযায়ী তাঁহাকে মহান রামায়ণের একত্বের সম্মানরক্ষার ভারও লইতে হইবে। তাঁহারা অবশ্যই জানেন না যে তাঁহাদের এই এক ও একক রামায়ণের উৎস কী, লেখক কে। সামান্য গবেষণাও বলিয়া দেয় যে, আর যিনিই হউন, এই লেখক বাল্মীকি নহেন, তাঁহার নায়কের সহিত উত্তর ভারতের শ্রীরাম চরিত্রের দূরত্ব অনেক। তাই কোনটি আসল, কোনটি অপভ্রংশ, কিছুই জানা না থাকায় পবিত্র আর বেনো জল আলাদা করিয়া রামায়ণের বহুত্বকে সামলাইবার দায়টি এখন এক ও অদ্বিতীয় সংঘেরই উপর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy