স্মৃতি ও বাস্তব। (বাঁ দিকে) পুরনো অ্যালবামে কলকাতার এক ইহুদি পরিবার, প্রৌঢ়ের বাগদাদি পোশাকের পাশে তাঁর নাতিদের সাহেবি পরিচ্ছদ লক্ষণীয়। ডান দিকে, মাগেন ডেভিড সিনাগগ, অশোক সিংহের তোলা ছবি। (নীচে) ইয়া এল সিলিমান।
কলকাতায় শাইলক নেই। বরং আছে কেক-কুকি’জ-খ্যাত নাহুম। এলিস জোশুয়ার ‘ট্রিঙ্কা’জ’। ছিলেন আগরপাড়া জুট মিলের প্রতিষ্ঠাতা বেঞ্জামিন এলিয়াস। এ শহরের হারিয়ে যেতে বসা ইহুদি-ঐতিহ্য এ রকমই। হারানো দিন তো ফেরানো যায় না, হয়তো ধরে রাখা যায় খণ্ডছিন্ন স্মৃতি। নতুন প্রজন্মের শিকড়ে ফেরার সূত্র। তারই লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে একটি নতুন ওয়েবসাইট, সদ্য যাত্রা শুরু হল তার।
এই ডিজিটাল আর্কাইভের দৌলতে ভেঙে যেতে চলেছে নানা ভ্রান্ত ধারণা। ইহুদি মানেই কি একদা-অত্যাচারিত একটি জাতি, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইজরায়েল নামে একটি দেশ পায়, এবং ইসলাম-বিদ্বেষের চোটে এখন প্যালেস্তাইনি শিশুদের রকেট হামলায় ছারখার করে দেয়? সব ইহুদিকে এক ছাঁচে ঢালার এই চিন্তাটিই অসার। পুরনো কলকাতায় যেমন বেশির ভাগই ছিলেন ‘বাগদাদি ইহুদি’। কেউ আসেন সিরিয়া থেকে, কেউ ইরাক বা ইয়েমেন থেকে। আজও এ শহরের ক্যানিং স্ট্রিটে ইহুদি ধর্মস্থান বা ‘সিনাগগ’-এর দারোয়ান এক মুসলমান। পোলক স্ট্রিটের জুয়িশ গার্লস স্কুলেও রয়েছেন অনেক মুসলিম ছাত্রী। ‘স্পেনের ইহুদি-ইতিহাসের চেয়ে পর্তুগাল আলাদা। ভারতীয় ইহুদিদের ইতিহাসও সমান আলাদা,’ বলছিলেন আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যার শিক্ষক ইয়া এল সিলিমান। কলকাতার এই কন্যার উদ্যোগে এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডসের প্রয়াসেই সম্ভব হয়েছে এই আন্তর্জালিক ইতিহাস-সৃষ্টি।
ভারতই দুনিয়ার একমাত্র দেশ, যেখানে ধর্মগত কারণে ইহুদিরা কখনও অত্যাচারিত হননি। সোনাদানা, রত্ন, জাফরান, এলাচ ও সুগন্ধি মশলার বাণিজ্য করতে ইহুদিরা বরাবর কোচিন, আগ্রা, মুম্বই, সুরাত, আমদাবাদে যাতায়াত করতেন। কোচিনের হিন্দু রাজা তাঁদের ক্রাঙ্গানোর অঞ্চলের শাসনভার দেন। সম্রাট আকবর ইহুদিদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করতেন। শিবাজির সেনাবাহিনীতেও ইহুদিরা ছিলেন। শিল্পী অনীশ কপূর থেকে প্রয়াত কবি-নাট্যকার নিসিম ইজিকিয়েল, লেখক কিরণ নাগরেকর, অনেকেই সেই ইহুদি ঐতিহ্যের সন্তান।
কোচিন, মুম্বইয়ের তুলনায় কলকাতার ইহুদি-সংস্কৃতি নতুন। সিরিয়ার সন্তান, রত্নব্যবসায়ী আরন ওবাদিয়া হা কোহেন ১৭৯৮ সালের ৪ অগস্ট এ শহরে পা রাখেন। তাঁর পথ ধরেই একে একে নাহুম, এজরা স্ট্রিট খ্যাত জোসেফ এজরা, এঁদের আগমন। কলকাতা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর। ফলে এখানে বসেই তাঁরা বাগদাদ থেকে সিঙ্গাপুর, পেনাং, ইয়াঙ্গন, জাকার্তা থেকে সাংহাই অবধি গড়ে তোলেন এক বাণিজ্যসাম্রাজ্য। চল্লিশের দশকে এ শহরে প্রায় ৫ হাজার ইহুদি। স্বাধীনতার পর অনেকেই ইজরায়েল, লন্ডন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়লেন। ইয়া এলের মা-বাবার মতো হাতে-গোনা ক’জন রয়ে গেলেন। তাঁর বাবা ডেভিড সিলিমান তখন কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জে ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্রোকার। মা ফ্লাওয়ার সিলিমান লোরেটো স্কুলে পড়াচ্ছেন। স্বাধীনতার সময় ফ্লাওয়ার দিল্লির আরউইন কলেজের ছাত্রী, মহাত্মা গাঁধীকে ইহুদি প্রার্থনাসঙ্গীত গেয়েও শুনিয়েছেন। সদ্য-স্বাধীন দেশের স্বপ্ন তখন এই দম্পতির চোখেও। কিন্তু ষাটের দশক থেকে কলকাতার চেহারা বদলে গেল। বোমাবাজি, জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন, পুঁজির পাততাড়ি গুটোনো। ’৭২ সালেই ছেলেমেয়েদের লন্ডন, নিউ ইয়র্ক পাঠিয়ে দিলেন তাঁরা। ফ্লাওয়ার নিজেও চলে গেলেন ইজরায়েল। কলকাতায় আজ মেরেকেটে কুড়ি-বাইশ জন ইহুদি, বেশির ভাগই বয়স্ক। ইয়া এল বলছিলেন, ‘দশ জন পুরুষ না হলে সিনাগগে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় না। এ শহরের সিনাগগ তিনটি তাই বেশির ভাগ সময় তালাবন্ধ থাকে, গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রয়োজনে ইজরায়েলি দূতাবাস লোক পাঠিয়ে দেয়।’ এ শহরে ইহুদিদের ক্রমাবলুপ্তি তাই নিছক এক ডায়াস্পোরার উত্থান ও পতন নয়। তার আড়ালে রয়েছে এক বাণিজ্যনগরীর ধ্বংসের ইতিহাস।
শহরের প্রথম ইহুদি পথিক আরন ওবাদিয়ার কথাই ধরুন। থাকতেন মুর্গিহাটায়, মাঝে মাঝেই যেতে হত লখনউ। সেখানে তিনি নবাবের দরবারে প্রধান জহুরি। মহারাজা রণজিত্ সিংহও কোহিনুরের দাম জানতে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওবাদিয়া জানিয়েছিলেন, কোনও দাম নেই। এটি এতই মূল্যবান যে, হিরের মালিক কোনও দিন বিক্রি করতে পারবেন না। শুধু প্রেমে এবং যুদ্ধেই হাতবদল সম্ভব। এই ওবাদিয়া কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মসলিন এবং মশলার পাশাপাশি এ শহরের ইহুদিদের অন্যতম লাভজনক ব্যবসা ছিল সিঙ্গাপুর, পেনাং, সাংহাইতে আফিম পাঠানো। আফিম যুদ্ধের পর ইহুদি লগ্নি ঢুকল শহরের রিয়াল এস্টেটে। চোখে পড়ার মতো স্থাপত্য এসপ্ল্যানেড ম্যানসন ইহুদিদের বানানো। তার সঙ্গে এজরা হাসপাতাল থেকে হাওড়ার বেলিলিয়াস পার্ক, চিড়িয়াখানার গাব্বে হাউস, আগরপাড়া জুট মিল, কৃষ্ণনগর ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি কলকাতার ইহুদিদের অবদান।
কলকাতার আরব-ইহুদি মানেই তা হলে বড়লোক শিল্পপতি? ইয়া এলের পরিষ্কার জবাব, ‘৫০ শতাংশই ছিলেন গরিব। তাঁদের সংসার চলত অন্যদের দানে। ৩৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত। এঁরা পরে নার্স, সেক্রেটারি, শিক্ষক হয়ে জীবিকা অর্জন করতেন। বড়লোক বলতে মেরেকেটে ১৫ শতাংশ। আমার প্রমাতামহ বাগদাদের ফেজ টুপির ব্যবসা করতে কলকাতায় এসেছিলেন, নিচুতলার ইহুদিরাই ছিলেন তাঁর ক্লায়েন্ট।’ জানালেন, হাচেম তানাও নামে এক ইহুদি ধর্মগুরু চিত্পুরে থাকতেন, আজও ইজরায়েলে তাঁর নাম সশ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়।
আর বাকিটা? বছর কয়েক আগে ইয়া এল তাঁর মা, দিদিমা, তস্য মাতার পারিবারিক জীবন নিয়ে জিউয়িশ পোর্ট্রেটস, ইন্ডিয়ান ফ্রেম্স নামে একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে দেখিয়েছিলেন, এই শহরে ইহুদি মেয়েরাও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কী ভাবে এগিয়ে গিয়েছিল। তাঁর দিদিমার মা স্বামীর চেয়ে ৩৫ বছরের ছোট, স্বামীর সঙ্গে দামাস্কাস থেকে সিঙ্গাপুর, সাংহাই যেখানেই যেতেন, ইহুদি অন্তঃপুরে থাকতেন। আরবি কাফতান ছাড়া অন্য পোশাক পরতেন না। ইয়া এলের মা আবার স্বামীর সঙ্গে পার্টিতে গেলে কখনও ট্রাউজার্স, কখনও শাড়ি। ইয়া এলের মা, দিদিমা এই শহরের জিউয়িশ গার্লসে পড়েছেন। স্বাধীনতার পরে জন্মানো ইয়া এল লোরেটো স্কুলে। উপনিবেশের প্রভাবে ইয়া এলের দিদিমার আমল থেকেই কলকাতায় ইহুদিদের রীতিনীতি বদলে যাচ্ছিল। হিব্রু ভাষায় প্রার্থনা করতেন ঠিকই, কিন্তু ভাষাটা লিখতে বা পড়তে জানতেন না। আমাদের সংস্কৃতের মতো। কলকাতায় ইয়া এলের দিদিমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল বাগদাদি পোশাকে। দিদিমার বিয়েতে আবার ইউরোপীয় ঢঙে সাদা পোশাক, হাতে ফুলের তোড়া। রান্নাঘরে মাছমাংস ইহুদি রীতিতে কাটা হয়েছে কি না তা নিয়ে ইয়া এলের দিদিমার প্রবল মাথাব্যথা ছিল। মা অতটা পাত্তা দিতেন না। ইয়া এলের মা, দিদিমার প্রজন্মে ইহুদি ছাড়া অন্য ধর্মে বিয়ে ব্যতিক্রমী ঘটনা। আর ইয়া এল? সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে বাঙালি বিয়ে।
কিন্তু উত্তরকালের কাছে নোম চমস্কির ছাত্রীর দায় কি এইটুকুই? বিধ্বস্ত গাজায় না গিয়ে কলকাতার লুপ্ত ঐতিহ্যের ওয়েবসাইট? হাসলেন ইয়া এল, ‘আজকের এই ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধটা রাজনীতিকদের তৈরি সন্ত্রাস। মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, হামাসের পাশে তাই এ বার সিরিয়া, মিশর, ইরাকও নেই। আপনার আইডেন্টিটি যখন একটাই হবে... মোসাদ, নয় হামাস, কিংবা ইজরায়েলি বা প্যালেস্তাইনি তখনই সমস্যা। আর আমার আইডেন্টিটি অনেক। ইহুদি, কলকাতার মেয়ে, ভারতীয়, দক্ষিণ এশীয়, নারীবাদী। এই কাজটায় সব পরিচিতিই থাকল।’
হিংসায় উন্মুখ কলকাতাকে বহু-পরিচিতির বহুত্ববাদী সংস্কৃতির কথাই মনে পড়িয়ে দিলেন ইয়া এল সিলিমান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy