শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ভাবছেন কোন বুদ্ধিতে আমির খান? প্রশ্নটা এ রকমই। —ফাইল চিত্র।
আমাদের ভাবনাতেও তো আসত না এ সব। আজ ভাবনায় এসে থামছে না শুধু, প্রশ্ন তুলছে, বিষ ছড়াচ্ছে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করছে।
ধর্মবিশ্বাসে তিনি মুসলিম, তা সত্ত্বেও হিন্দু মহাকাব্যে নির্ভর ছবিতে অভিনয় করার কথা ভাবছেন কী ভাবে আমির খান? মহাভারত নিয়ে ছবি হলে তাতে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ভাবছেন কোন বুদ্ধিতে আমির খান? প্রশ্নটা এ রকমই।
প্রশ্নটা তুলেছেন এক ফরাসি সাংবাদিক। সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতে রয়েছেন এই ফরাসি। আমির খানের দিকে তাঁর ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন এখন অবশ্য আর শুধু তাঁর নেই। টুইটারে ঝড় উঠে যাওয়ার উপক্রম। অনেকেই প্রশ্নকর্তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এ প্রশ্নকে লুফে নেওয়ার লোকও যে আজকের ভারতে কম নেই, তাও বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এ রকম তো ছিলাম না আমরা! মহাভারত নিয়ে টেলিভিশনে যে ধারাবাহিক হয়েছিল, তা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল গোটা দেশে। ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রয়ে গিয়েছে সে ধারাবাহিক। হিন্দু মহাকাব্য নির্ভর সেই ধারাবাহিকে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন, তাঁরা কি সকলে ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু ছিলেন? ছিলেন না। কেন সব অভিনেতা হিন্দু নন, সে প্রশ্ন কিন্তু সে দিন ওঠেনি। মহাভারত নিয়ে ধারাবাহিক হলে, সে ধারাবাহিকের সব অভিনেতাকে হিন্দুই হতে হবে, এমন কোনও ভাবনাই এ ভারতের মনে সে দিন উঁকি দেয়নি। কিন্তু সেই যুগকে বেশ কয়েকটা দশক পিছনে ফেলে এসে যখন আমরা ভাবছি, এ ভারত আরও আধুনিক ভারত, তখনই আশ্চর্য হয়ে দেখছি, আমাদের চেতনার যাত্রাটা সম্পূর্ণত সামনের দিকে হয়নি, পিছনের দিকেও হয়েছে বেশ খানিকটা।
আরও পড়ুন
মুসলিম হয়েও আমির মহাভারত সিনেমায় কেন? ঝড় তুলল ‘অসহিষ্ণু’ টুইট
শিল্পীর যে জাত-ধর্ম হয় না, সে কথা ভারত শতকের পর শতক ধরে জানে। এ দেশে মুসলিম শিল্পী হিন্দু রাজার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। এ দেশে হিন্দু সঙ্গীতজ্ঞ মুসলিম শাসকের সভা-গায়কের মর্যাদা পেয়েছেন। এ দেশ আলাউদ্দিন খাঁয়ের বাড়িতে রবিশঙ্করকে গড়ে উঠতে দেখেছে। এ দেশ দেখেছে বারাণসীতে গঙ্গার যে ঘাট হিন্দুর তীর্থক্ষেত্র হিসেবে গণ্য, সাতসকালে সে ঘাটে না গেলে সানাই ধরার প্রেরণা পান না বিসমিল্লা। সেই ভারতে যখন প্রশ্ন ওঠে, আমির খান কেন অভিনয় করবেন শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায়, যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হতে হয় বই কি!
সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার বিষকণা যে ঢুকে গিয়েছে এ দেশের শিরায়, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ বিষকণার উপস্থিতি আজ যতটা ঝাঁঝালো, দু-তিন দশক আগে বা তারও আগে যে ততটা ছিল না, তাও বোঝা যায় আজ বেশ।
আমির খানই প্রথম নন, যাঁকে এমন অনুদার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল। কখনও শাহরুখ খান এ রকমই কোনও প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। কখনও শাবানা আজমির দিকে তির ছোড়া হয়েছে, কখনও মকবুল ফিদা হুসেনের দিকে। কখনও গুলাম আলির অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়েছে। কখনও আবার তসলিমা নাসরিনকে শহরছাড়া করা হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না বিষটা। শাহরুখ, আমির, সলমনদের ছবি নিয়ে গোটা দেশেই প্রবল মাতামাতি হয়। কিন্তু দেশে অসহিষ্ণুতা বাড়তে দেখে যখনই মুখ খোলেন তাঁরা, তখনই তাঁদের ‘শিল্পী’ পরিচয়টা এক শ্রেণির ভারতীয় ভুলে যান। তখনই তাঁদের ‘মুসলিম’ হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয়।
দেশে আজ যে কট্টর হিন্দুত্বের জিগির, আমির খানকে নিয়ে তোলা প্রশ্নটা সেই জিগিরের সঙ্গে ওতপ্রোত। কিন্তু সনাতন ধর্মে বা সনাতন ভারতীয় পরম্পরায় এই জিগিরের কোনও ঠাঁই নেই। ভারতের সনাতন ঐতিহ্য এই অনুদার মানসিকতার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থান করে।
বিষকণাগুলোই বিপদ ডাকছে। এর বিরুদ্ধে এ বার একটা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় কিন্তু এসে গিয়েছে। ভারতের চিরন্তন ঐতিহ্যের বিপরীতে গিয়ে, ভারতের পরম্পরার অমর্যাদা করে, ভারতের সামাজিক বুনটটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যে সব কণ্ঠস্বর প্ররোচনা দেওয়ার চেষ্টা করবে, সে সব কণ্ঠস্বরকে সমস্বরে বাধা দিতে হবে। বিষটাকে আর একটুও ছড়াতে দিলে চলবে না। বাধা যদি না দিই আজ, বিষকণা কিন্তু অচিরেই বিষবৃক্ষ হয়ে উঠবে। সে দিন ব়ড় সুখের হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy