Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

যস্মিন্ দেশে

অপরাধের কল প্রায়শ্চিত্তে নড়ে কি? মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-র জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকরা ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ২৭২ জন ক্রীতদাসকে বিক্রয় করিয়া প্রতিষ্ঠানের ঋণের বোঝা লাঘব করিয়াছিলেন।

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:২৪
Share: Save:

অপরাধের কল প্রায়শ্চিত্তে নড়ে কি? মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-র জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকরা ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ২৭২ জন ক্রীতদাসকে বিক্রয় করিয়া প্রতিষ্ঠানের ঋণের বোঝা লাঘব করিয়াছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কর্তারা সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিতে উদ্যোগী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিহাসের সন্তান। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এক কালে দাসব্যবসার অর্থে প্রতিষ্ঠিত বা লালিত হইয়াছে। তাহাদের কেহ কেহ সেই ঐতিহাসিক দায় স্বীকার করিয়াছে, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়াছে। কিন্তু জর্জটাউন কেবল ইহাতেই নিজেকে সীমিত রাখে নাই, আরও কয়েকটি পদক্ষেপের অঙ্গীকার করিয়াছে। দাসপ্রথা সম্পর্কে চর্চার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈয়ারি হইবে, যে ক্রীতদাসদের শ্রমে এই বিদ্যায়তন নির্মিত হইয়াছিল তাঁহাদের একটি স্মারক প্রতিষ্ঠা করা হইবে, তাঁহাদের এবং দুই শতাব্দী আগে বিক্রীত দাসদের উত্তরপ্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাইবেন, হয়তো ভবিষ্যতে তাঁহাদের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থাও হইতে পারে।

দুই শতক অতীতের অন্যায় অতীত হইয়া গিয়াছে, কোনও ভাবেই তাহার প্রতিকার সম্ভব নয়। তাহা হইলে মার্জনাভিক্ষা বা প্রায়শ্চিত্তের অর্থ কী? কেবল জর্জটাউন বা ক্রীতদাস প্রসঙ্গে নয়, অতীত অন্যায় এবং ভবিষ্যৎ প্রায়শ্চিত্তের যে কোনও দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্ন ওঠে। প্রায়শ্চিত্তে অতীতের কোনও লাভ নাই, লাভ বর্তমান এবং ভবিষ্যতের। পূর্বপ্রজন্মের অন্যায়কে স্বীকার করিয়া এবং তাহার জন্য ক্ষমা চাহিয়া বা অত্যাচারিতের উত্তরপ্রজন্মকে বিশেষ সাহায্য করিয়া মানুষ নিজেকে এক ধরনের কল্যাণের প্রয়াসে যুক্ত করিতে, এবং তাহার মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করিতে চাহে। জাগতিক নহে, আত্মিক উন্নতি। ক্রীতদাস প্রথাকে স্বীকৃতি দিয়া এবং সেই প্রথার ইতিহাস চর্চার আয়োজন করিয়া জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের চালকরা আত্মোন্নতির নূতন সুযোগও সৃষ্টি করিতেছেন। তাঁহাদের চিন্তায় মানবিকতা আছে।

আছে সাহসও। যে সাহস অপ্রীতিকর অতীতকে ভুলিয়া থাকিতে ও ভুলাইয়া রাখিতে চাহে না, বরং স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করিয়া লয়। সেই স্বীকৃতিতে কোনও গরিমা নাই, বরং লজ্জার কারণ আছে। সুস্থ, স্বাভাবিক, মানবিক লজ্জা। তাহাকে সৎসাহসের সহিত মানিয়া লইবার মানসিকতা কোনও দেশেই সুলভ নহে, ভারতে তো অতি দুর্লভ। এ দেশে কৃতকর্মের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার চল নাই। মাঝে মাঝেই এক ব্যক্তি বা দল অন্য ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে ক্ষমা চাহিতে হইবে বলিয়া শোরগোল তোলে, কখনও কখনও নিজের স্বার্থ বাঁচাইতে অভিযুক্তরা ক্ষমা চাহিয়া লয়, কিন্তু তাহা নিছক লোকদেখানো, কৃত্রিম, অ-সৎ। সম্ভবত এই প্রবণতার পিছনে থাকে একটি গভীর সামাজিক কারণ। এ দেশের সমাজ মজ্জায় মজ্জায় অতীতমুখী। খোলা মনে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হইবার মানসিক স্ফূর্তি ভারতীয় সমাজে সুলভ নয়। সেই স্ফূর্তি থাকিলে জাতপাতের বালাই আজও এতখানি প্রবল আকার ধারণ করিয়া থাকিত না। এ দেশের বহু অঞ্চলে উচ্চবর্ণের মানুষ আজও নিম্নবর্গের উপর যে পীড়ন চালায়, তাহা দাসপ্রথা অপেক্ষা কম অপরাধের ব্যাপার নয়। স্বভাবতই ক্ষমাপ্রার্থনার কোনও প্রসঙ্গই ওঠে না। মার্কিন সমাজে অতীতের আধিপত্য তুলনায় কম বলিয়াই হয়তো জর্জটাউনের ঘটনা ঘটিতে পারিয়াছে। যে দেশে যেমন আচার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE