Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সাক্ষাত্কার

‘সুশোভন সরকারের কাছেই পালিয়ে গেলাম’

গত ২৬ নভেম্বর বিদায় নিয়েছেন ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেনসেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ ইতিহাসের শিক্ষকতপতী গুহঠাকুরতা ও লক্ষ্মী সুব্রহ্মণ্যম। কথোপকথনের নির্বাচিত অংশ।গত ২৬ নভেম্বর বিদায় নিয়েছেন ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেনসেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ ইতিহাসের শিক্ষকতপতী গুহঠাকুরতা ও লক্ষ্মী সুব্রহ্মণ্যম। কথোপকথনের নির্বাচিত অংশ।

আমরা যা ছিলাম। (উপরে বাঁ দিক থেকে, ঘড়ির কাঁটার চলন অনুসারে) সুশোভন সরকার, নীহাররঞ্জন রায়, সুকুমার সেন এবং যদুনাথ সরকার।

আমরা যা ছিলাম। (উপরে বাঁ দিক থেকে, ঘড়ির কাঁটার চলন অনুসারে) সুশোভন সরকার, নীহাররঞ্জন রায়, সুকুমার সেন এবং যদুনাথ সরকার।

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

তপতী: তপনদা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার ইতিহাস পড়ার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই। স্কটিশ চার্চ কলেজের স্নাতক হয়ে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন। কেমন ছিল সেখানে ইতিহাসচর্চার পরিবেশ?

তপন: শেখার বিষয়ে, আমার ঋণ প্রধানত এক জন মানুষেরই কাছে, সুশোভন সরকার। ইতিহাস-ভাবনার সবটাই ওঁর কাছ থেকে শেখা, যদিও প্রথমে আমার ইতিহাস পড়ার পরিকল্পনা ছিল না। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে চেয়েছিলাম। স্কটিশ চার্চে গিয়েছিলাম এক ‘গুরু’র আকর্ষণেই, মিস্টার মোট, বিখ্যাত শিক্ষক। তারক সেনও আর এক বিখ্যাত শিক্ষক, উনি ছিলেন প্রেসিডেন্সিতে। তা, ওঁর ক্লাস তো ওখানে গিয়েই করে নিতে পারি, কিন্তু আমি এমন এক জনের কাছে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ নিতে চেয়েছিলাম, যাঁর মাতৃভাষা ইংরেজি। সে দিক থেকে, তখন কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষক এই মিস্টার মোট।

তপতী: সুশোভন সরকারের ক্লাসে কী করে পৌঁছলেন?

তপন: এক জন আমার তখন বিশেষ বন্ধু ছিলেন, পরে যিনি বিরাট নাট্যকার হন, বাদল সরকার। ওঁর বাড়িতে নিয়মিত আড্ডা মারতে যেতাম। ওঁর দাদু পিয়ারি সরকারের নামে রাস্তা, সেখানেই ওঁদের বাড়ি। ওঁর বাবা অবশ্য একটু অসুস্থ ছিলেন, কথা বলতে পারতেন না। উনি একটা কথা বলেছিলেন, ‘দেখো, আমাদের দেশের কত লোকই তো ইংরেজি পড়েছেন, একটা বিশাল ঐতিহ্য বলা যেতে পারে, প্রফুল্ল ঘোষ, তারক সেন, আরও কত। কিন্তু কেউই কিন্তু ইংরেজি নিয়ে তেমন কিছু করতে পারেননি।’ আসলে, এটা একটা ঔপনিবেশিক ভাবনার ধরন। ‘কিন্তু আমরা তো ঔপনিবেশিক মানুষই বটে, ইংরেজি সাহিত্যের ফিল্ডটা আসলে ইংরেজদেরই।’ তবে সুকান্ত চৌধুরীর কথাটাও ধরতে হয়, কিংবা শুভা মুখোপাধ্যায় যিনি শেক্সপিয়র স্টাডিজ-এর উল্লেখযোগ্য নাম। আসলে এখন পরিস্থিতিটা পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু এই কথাটা যখন বাদল সরকারের বাবা মহেন্দ্র সরকার বলেছিলেন, ঠিকই বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যদি প্রফেশনাল স্কলার হতে চাও, ইংরেজি সাহিত্য পোড়ো না, ইতিহাস পড়ো। মুঘল ইতিহাস পড়তে পারো। স্যর যদুনাথ তো রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছেন, তুমি মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে পারো।’ কথাটা আমার বেশ মনে ধরেছিল। আরও বলেছিলেন, ‘ইতিহাস পড়ো, কিন্তু সুশোভনের কাছে পালিয়ে যেয়ো না।’ আমি অবশ্য জানতাম যে, ইতিহাস পড়লে আমি ওঁর কাছেই যাব। শেষ পর্যন্ত, তাই হল, ইতিহাসই পছন্দ করলাম। আর সুশোভন সরকারের কাছেই পালিয়ে গেলাম।

তপতী: স্কটিশ চার্চে পড়তে পড়তে প্রেসিডেন্সিতে সুশোভন সরকারের ক্লাস করলেন?

তপন: না না, আমিই চলে গেলাম, প্রেসিডেন্সিতে। অবশ্য একই হোস্টেলে থেকে গেলাম, ডাফ হোস্টেল। আরও আগে ডাফ হোস্টেল অ-খ্রিস্টান ছাত্রছাত্রীদেরও থাকতে দিত, কোনও পয়সা লাগত না। তবে আমরা সেই সুযোগ পাইনি, ওই ব্যবস্থাটা উঠে গিয়েছিল। আসল ব্যাপারটা অবশ্য অন্য, ওরা চাইত ধর্মান্তর করতে, ভাবত যদি এরা খ্রিস্টানদের সংস্পর্শে আসে, তবে হিন্দু সমাজে এরা ব্রাত্য হয়ে যাবে, খ্রিস্টান হওয়া ছাড়া গতি থাকবে না। যা হোক, আমি ওই হোস্টেলেই থেকেছি, খুবই ভাল ব্যবস্থা।

তপতী: সেটা কোন সময়ে?

তপন: ১৯৪১ থেকে ’৪৮। আত্মজীবনীতে আছে সে সময়ের কথা।

তপতী: একটু বিষয়ান্তরে যাই। আচ্ছা, মুঘল সাম্রাজ্যের কোন দিকটা আপনাকে আকর্ষণ করত?

তপন: বলছি, তার আগে বলি, জানো তো, বরিশালের স্কুলজীবনে কিন্তু আমার অনেক ভাল মুসলিম বন্ধু ও মুসলিম শিক্ষক ছিলেন। মুসলিম জীবনযাপনের ব্যাপারে আমার বেশ একটা আকর্ষণবোধ ছিল তখন থেকেই। এমনিতেই আমি কখনও ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ নই, বলতে পারো তৃতীয় প্রজন্মের নাস্তিক। কিন্তু ওই যে ইসলামি জীবনের একটা আলাদা স্বাদ, সেটায় বেশ একটা রোমান্স খুঁজে পেতাম আমি। সুরাবর্দি পরিবারে আমার বন্ধু ছিল, তা ছাড়া অন্যান্য মুসলিম পরিবারে বা পাঠান পরিবারের সঙ্গেও ভাব ছিল। ওদের বাড়িগুলোর মধ্যে কেমন একটা মধ্য এশিয়ার পুরনো ঐতিহ্যের ভাব, দারুণ লাগত সেটা আমার। ইসমাইল খানের ছেলে শাজাহান, শাজুকাকা, আমার খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। তাঁর ভাই জাহির খানও।

তপতী: উত্তর ভারতের মুঘল সংস্কৃতির কতটা ছাপ ছিল এই সময়কার বাংলায়?

তপন: জাতিগত ভাবে এঁরা ছিলেন পাঠান। জানো তো, এঁদের জীবনে সবচেয়ে গুরুতর ছিল খাওয়াদাওয়া। ইসমাইল খানের বাড়ি থেকে সর্বক্ষণ কিছু না কিছু বিষয়ে নিমন্ত্রণ আসত। আমার প্রায় সব বন্ধুই মুসলিম মধ্যবিত্ত, যাদের জীবনযাপন মুসলিম এলিটদের থেকে অনেকখানি আলাদা। এই ব্যাপারটা আমাকে খুব টানত। অনেকগুলো কারণে আমি ফারসি ভাষা শিখতে মনস্থ করি। ১৯৩৭ সালে, সেভেন্থ ক্লাসে পড়ার সময়ে মৌলবির কাছে গিয়ে বললাম, ফারসি শেখাবেন আমায়, আলাদা ভাবে? মাসে পাঁচ টাকা দিয়ে ফারসি পড়া শুরু হল। অবশ্য কোনও কালেই আমার ফারসি শিক্ষা খুব ভাল দাঁড়াল না। ভাবলে দুঃখই হয়। আসলে প্রথম থেকেই আমার ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব, এক দিকে চাইতাম ইংরেজি সাহিত্য পড়তে, অন্য দিকে মুঘলদের উপর গবেষণা করতে। হবিবুল্লা ও মাখন রায়চৌধুরী পড়াতেন। আমাদের সময়ে তুর্ক-আফগান সাম্রাজ্য আর মুঘল সাম্রাজ্য মিলে একটা পেপার ছিল। পড়ানো হত ঈশ্বরী প্রসাদ... না, যদুনাথ সরকার পড়ানো হত না কিন্তু।

লক্ষ্মী: স্যর যদুনাথকে আপনার এমএ পড়ার সময় পাননি তা হলে?

তপন: আমি নিজের আগ্রহে তাঁর বইগুলি পড়েছিলাম, কিন্তু ক্লাসে পড়ানো হত না তখন।

তপতী: তার মানে, তাঁর বই অন্য অনেকেই পড়তেন, কিন্তু ক্লাসে পড়ানো হত না? এর কারণ কী, কী মনে হয় আপনার?

তপন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর প্রতি বিমুখ তখন। আশুতোষ আর স্যর যদুনাথের মধ্যেকার শত্রুতা।... ওই সময়ে যিনি আমায় গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করলেন, তিনি হলেন নীহাররঞ্জন রায়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পড়াতেন, আর লাইব্রেরি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পাশ করার পরেও তিনিই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তখন তিনি ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব’ লিখছেন। তাঁর মহাগ্রন্থ, দারুণ কাজ। সেই সময় ক্লাসে বলতেন, এমন একটা কাজ পুরোটা কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। বলতেন, আমি আকর থেকে ধাতু সংগ্রহ করেছি, কিন্তু তাই দিয়ে কোনও অলঙ্কার তৈরি করতে পেরে উঠিনি। তাঁর ক্লাস মানে অবশ্য আর্ট হিস্ট্রি-র ক্লাস। সেগুলো আমার শোনা হত না, কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে রোজই দেখা করতাম, আড্ডা আর কী। বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেনেট হাউসে, ওঁর একটা অফিস ছিল, সেখানে যেতাম।

তপতী: ছাত্র থাকার সময়ও সিনিয়র প্রফেসরদের কাছে যেতে পারতেন?

তপন: হ্যাঁ। পারতাম। পুরোপুরি। মাখন রায়চৌধুরীর কাছেও যেতাম।

তপতী: আচ্ছা, স্টেলা ক্রামরিশ-এর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল? উনিও তো তখন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস পড়াতেন?

তপন: যখনই স্টেলা কমন রুমে ঢুকতেন, অনেক অধ্যাপকই মুশকিলে পড়ে যেতেন, এই রে, এই বার ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। অনেকেই তখন ইংরেজি বলতে পারতেন না। বিশেষত জিতেন বন্দ্যোপাধ্যায়। বলতেন, এই মেমসাহেব আসছে, ইংরেজি বলতে হবে, আমি চলে গেলাম!

লক্ষ্মী: তপনদা, একটা বিশেষ কথা আপনার কাছে জানতে চাই। আকবর ও জাহাঙ্গিরের আমলের বাংলা বিষয়ে। বরিশালের অভিজ্ঞতা, নানা রকম সামাজিক অভিজ্ঞতার কারণে আপনি কী ভাবে মুঘল বাংলার বিষয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন সেটা শুনলাম। ভাবছিলাম, এই যে সামাজিক ইতিহাসের প্রতি আপনার আকর্ষণ, সেই ইতিহাসচর্চা আপনি কী ভাবে শুরু করলেন? ...

... তপতী: নীহার রায়ের বইটি কি একটা অনুপ্রেরণা ছিল? মানে, এটা তো ঠিক যদুনাথ সরকারের ইতিহাস নয়, তার চেয়ে অনেকটা আলাদা।

তপন: হ্যাঁ, বলতে পারো, তবে ঠিক প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা নয়। আমি ওঁর সঙ্গে রোজ কথা বলতাম। উনি প্রতিটি অধ্যায়ে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। উনিই আমার আসল সুপারভাইজার ছিলেন সে দিক থেকে।

তপতী: আর সাহিত্যকে ইতিহাসের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে?

তপন: তখনও পর্যন্ত ওটা ছিল বিতর্কিত ব্যাপার। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি সাহায্য পেয়েছিলাম সুকুমার সেনের কাছ থেকে, এমন কিছু নেই যা উনি জানতেন না। ওঁর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা খুবই সহজ ছিল, অবশ্য যদি ওঁর প্রবল বকুনি সহ্য করতে পারো! কিছু ভুল হলেই সোজা কথা, ‘এ সব যখন জানেন না, তখন লেখাপড়া করতে এসেছেন কেন? গিয়ে রাস্তায় ইঁট ভাঙুন!’ অমলেশ ত্রিপাঠীও সুকুমারবাবুর কাছে নস্যি! তাঁর পদটা ছিল লিঙ্গুইস্টিকস বিভাগের অধ্যাপক, কিন্তু আশ্চর্য, উনি পড়েননি এমন জিনিস নেই! ভারতীয় সাহিত্যের সমস্ত কিছু পড়ে ফেলেছিলেন। ভাষা জানতেন অনেকগুলো। আমি ওঁর কাছ থেকে ঐশ্বর্যও যেমন পেয়েছি, গালিগালাজও পেয়েছি। চোখাচোখা শব্দবাণ!

লক্ষ্মী: তপনদা, এত জন বড় বড় স্কলার-এর সঙ্গ পেয়েছেন আপনি। তখনকার দিনে কি এটাই স্বাভাবিক ছিল? মানে, এটাই কি সেই সময়কার অ্যাকাডেমিক কালচার ছিল?

তপন: হ্যাঁ, তখন এটাই স্বাভাবিক ছিল। ছোটবেলা থেকেই অনেক বড় স্কলারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। বরিশালে তখন ইতিহাস আর দর্শনের বড় স্কলারদের পাওয়া যেত। সুরেন সেন, রমেশ মজুমদার, সুরেন দাশগুপ্তও ছিলেন।

তপতী: এঁরা কি বরিশালের কলেজে পড়াতেন?

তপন: না না, বরিশাল কলেজে না, এঁরা বরিশালেরই লোক। রমেশ মজুমদার অবশ্য বরিশালের ছিলেন না, তিনি ছিলেন ফরিদপুরের লোক, কিন্তু বরিশালের জামাই। আমাদের বাড়িতেও এঁদের আনাগোনা ছিল। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী আমাদের আত্মীয় ছিলেন। আমার বাবার ফার্স্ট কাজিনকে বিয়ে করেছিলেন। উনি আর এক জন। স্যর যদুনাথ কারও সম্পর্কে ভাল কথা বলতেন না, কিন্তু ওঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন!

কৃতজ্ঞতা: অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE