Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘আমার উপর রাগ থাকে তো পরের ভোটে আমাকে ভোট দেবেন না’, সৌগত

দলের অন্দরে-বাইরে ক্রমাগত সমালোচনা এবং আমজনতার চায়ের আড্ডা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের যে ধাক্কা আছড়ে পড়েছে, তা সামলাতে অবশেষে হুল কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত সৌগত রায়কে বলতে হল, তিনি লজ্জিত!

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০৩:২১
Share: Save:

দলের অন্দরে-বাইরে ক্রমাগত সমালোচনা এবং আমজনতার চায়ের আড্ডা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের যে ধাক্কা আছড়ে পড়েছে, তা সামলাতে অবশেষে হুল কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত সৌগত রায়কে বলতে হল, তিনি লজ্জিত! এবং বলতে হল যে, তাঁর উপরে রাগ করে যেন দলের অন্য সৎ প্রার্থীকে বঞ্চিত করা না হয়! এবং যত দিন তিনি এর থেকে মুক্ত না হচ্ছেন, তত দিন যেন তাঁকে ভোট না দেওয়া হয়। ঠিক যে কথাটা শুক্রবার বলেছিলেন দলের সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী। পরোক্ষে নেত্রীর বিরোধিতা করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘দলের সভাপতি হলে আমি ওঁদের (ঘুষ কাণ্ডে অভিযুক্ত দলীয় সাংসদদের) ইস্তফা দিতে বলতাম।’’

এই দীনেশই নারদ ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পরে আর এক সাংসদ সুগত বসুর সঙ্গে দলীয় বৈঠকে তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। ঘুষ কাণ্ডে অভিযুক্তদের সঙ্গে সংসদ চত্বরে দলীয় ধর্নাতেও যাননি। নেত্রী নিজে গোড়া থেকেই চুপ ছিলেন। তাঁর শীর্ষ নেতাদেরও জানিয়ে দিয়েছিলেন, জনসভায় নারদ নিয়ে যেন একটি কথাও না বলা হয়। বরং ভোটারদের দরজায় দরজায় গিয়ে তাঁদের বোঝানোয় জোর দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর পরেও বেফাঁস মুখ খোলার পর্ব জারি থেকেছে। কখনও হাইকোর্টে দলের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, নির্বাচনের আগে এমন কোনও নির্দেশ যেন কোর্ট না দেয়, যাকে বিরোধীরা হাতিয়ার করতে পারে। সেই সঙ্গে এ-ও বলেন, অনুদান ও ঘুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একই কথা শোনা গিয়েছে দলের দুই প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়া এবং চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের মুখে। তার পরেই দীনেশের বোমা। যা দলের অস্বস্তি আরও বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, এ সবের মোকাবিলা কোন পথে?

নেত্রী যেমন এখনও বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মুখ খুলছেন না। শনিবার জঙ্গলমহলে তিনটি সভা করেছেন তিনি। সেখানে নারদ নিয়ে সরাসরি কোনও শব্দ নেই। শুধু খড়িকামাথানির সভায় এক বার বলেছেন, ‘‘(সিপিএম নেতারা) বলে বেড়াচ্ছেন সব তৃণমূল চোর। আর ওনারা সাধু!’’

কিন্তু মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে এই রক্ষণের চেষ্টাতেও যে বিশেষ লাভ হচ্ছে না, তা পরিষ্কার। বাসে-ট্রেনে, চায়ের দোকানে এমনকী ফুটপাথে ভিড় বাঁচিয়ে হাঁটা অফিসফেরতা জনতারও ইদানীং আড্ডার বিষয়বস্তু নারদ-ভিডিও। প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে টিভি নেই, সেখানে বিরোধী দলের কর্মীরা মোবাইলে দেখাচ্ছেন তৃণমূল নেতাদের টাকা নেওয়ার ভিডিও। বাজারে যাওয়া তৃণমূল নেতাকে পর্যন্ত মুচকি হেসে লোকজন জিজ্ঞাসা করছে, ‘‘কী ব্যাপার, এত বড় মাছ কিনছেন!’’

এই অবস্থায় মুখ খোলার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছেন সকলেই। কিন্তু মুখ খুললেও বিপদ! যেমন হয়েছে সৌগতবাবুর ক্ষেত্রে। খড়দহে অমিত মিত্রের সমর্থনে একটি সভায় তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের কাছে বলতে আমি লজ্জিত যে, আমার নামটা ওর মধ্যে জড়িয়েছে। যদি আপনাদের আমার উপর রাগ থাকে তো পরের ভোটে আমাকে ভোট দেবেন না। কিন্তু এই ভদ্রলোক (অমিত মিত্র) সৎ ভদ্র ও সংযত। ওঁর জন্য ভোট ভিক্ষা করছি।’’ পরে সৌগতবাবু আর তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে চাননি। কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য, সৌগতবাবুর কথা থেকেই পরিষ্কার—

১) টাকা নিয়েছেন বলেই তিনি কুণ্ঠিত (ভিডিওতে তাঁকে টাকা নিতে দেখেই সব থেকে বেশি চমকেছেন মানুষ, জানা গিয়েছে সমীক্ষায়)।

এবং

২) অমিত মিত্র সৎ, তিনি নন!

‘ডাকাবুকো নেতা’ শুভেন্দু অধিকারীর গলায় আবার অন্য সুর। নন্দীগ্রামের ডগলাস মোড়ে এক সভায় তিনি আজ বলেছেন, ‘‘খবরের কাগজ দিচ্ছে আমার হাতে? (নারদ কাণ্ডে তাঁকে খবরের কাগজে মুড়ে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল) কাগজে কী আছে? মিষ্টি আছে, ফুল আছে না টাকা আছে— তা প্রমাণ করতে হবে নারদকে। শুভেন্দু অধিকারী ছেড়ে কথা বলবে না।’’ যা শুনে বিরোধীরা বলছেন, এই শুভেন্দুই ঘনিষ্ঠমহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ‘সামলে নেব’ বলে বড়াই করেছেন। সেই তিনি নারদকে নিয়ে এত শব্দ খরচ করছেনই বা কেন?

তৃণমূল সূত্রে খবর, শুক্রবার টিভিতে দীনেশের বাণী শুনেই রেগে যান মমতা। মুকুল রায়-সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের নির্দেশ দেন, তাঁরা যেন দীনেশকে শান্ত করেন। বলে দেন, আর যেন কোনও বেঁফাস কথা না বলেন তিনি। দলনেত্রীর নির্দেশেই তার পর আজ সাংবাদিক বৈঠক করে ক্ষত মেরামতি করতে নামেন তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ। বলেন, ‘‘দীনেশের সঙ্গে আমার তিন বার কথা হয়েছে। উনি পঁচিশ মিনিট বক্তৃতা দিয়েছেন, কিন্তু ছেঁটেকেটে দেখানো হয়েছে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের ফুটেজ।’’ দীনেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যান সুদীপ। ঘটনা হল, আগে ঠিক ছিল সুদীপের সঙ্গে মুকুলও আজ ওই সাংবাদিক বৈঠকে থাকবেন। কিন্তু নারদ ফুটেজে তিনি ছিলেন। তাই ভেবেচিন্তে মুকুলকে আর সাংবাদিক বৈঠকে পাঠানো হয়নি।

নারদ-কাণ্ড সংসদের নীতি কমিটিতে পাঠানো নিয়ে আপত্তি ছিল তৃণমূলের। সুদীপ কিন্তু আজ বলেন, ‘‘এথিক্স কমিটি গঠন নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে। কিন্তু তা যখন তৈরি হয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে সেটাকে মেনে নেওয়াই ভাল।’’ তাঁর এই মন্তব্যে তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান বদলের অভিযোগ তোলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে বিরোধীরা। অনেকের মতে, নীতি কমিটিকে মেনে নিয়ে এ বার নারদের আসল তদন্তটাকেই হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার ছক কষছে টিম মমতা।

কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে কি? এক দিকে আমজনতা সরব, অন্য দিকে বন্ধ হচ্ছে না বিরোধীদের মুখ। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন বলেন, ‘‘জানতাম দীনেশদার পরামর্শ মমতা নেবেন না। তৃণমূলে যে হুলের জ্বালা ধরে গিয়েছে, তা ওদের ছটফটানি দেখেই বোঝা যাচ্ছে!’’ সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিশ্বাস করি না, সব তৃণমূল নেতা-কর্মীর মেরুদণ্ড বিকিয়ে গিয়েছে। তৃণমূলে যাঁরা সৎ, তাঁরা ভোটবাক্সে প্রতিবাদ জানান। কারণ এর পরেও তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার অর্থ অপরাধ, চুরি ও ঘুষকে স্বীকৃতি দেওয়া।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE