Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বৈজ্ঞানিক রিগিং রুখবে কমিশন, জানালেন জৈদী

বৈজ্ঞানিক রিগিং রুখতে এ বার বৈজ্ঞানিক দাওয়াই দেবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন সদনে আনন্দবাজার পত্রিকাকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এ বার আর ভূতেরা পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারবে না।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৪
Share: Save:

বৈজ্ঞানিক রিগিং রুখতে এ বার বৈজ্ঞানিক দাওয়াই দেবে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন সদনে আনন্দবাজার পত্রিকাকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এ বার আর ভূতেরা পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারবে না। তার জন্য এক দিকে যেমন ভূতেদের বাছাই অভিযান চলছে, তেমনই ভোটের দিন আসল ভোটারের বদলে কেউ ভূত সেজে বুথে এলে তা ঠেকানোর ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হচ্ছে। এ রাজ্যের ভোটে বৈজ্ঞানিক রিগিংয়ের ভূরি ভূরি অভিযোগ কমিশনে জমা পড়েছে। সেই কারণে কমিশনও অন্যান্য বারের চেয়ে বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছে, জানিয়েছেন জৈদী।

ভোট হতে চলা কোনও রাজ্যের সংবাদমাধ্যমকে এই প্রথম সাক্ষাৎকার দিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। জানালেন, কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে বুথের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। ভোটার তালিকা সংক্রান্ত কোনও কারচুপি ঠেকানো কমিশনের পরবর্তী অগ্রাধিকার। পাশাপাশি প্রত্যেক দলের পোলিং এজেন্ট যাতে ভোট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত বুথে থাকতে পারেন, সেটাও নিশ্চিত করবে কমিশন। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ কোনও ভাবে ভোট প্রক্রিয়া বানচাল করতে এলে কঠোর পদক্ষেপ করা হবে, এই হুঁশিয়ারিও আমি দিয়ে রাখছি। বুথের মধ্যে যাতে কোনও রকম কারচুপি না হয়, তা এ বার নিশ্চিত করা হবে।’’

বৈজ্ঞানিক রিগিং গণতন্ত্রের ইতিহাসে বাঙালিদের এক অভিনব অবদান। আলিমুদ্দিনের প্রয়াত নেতা অনিল বিশ্বাসকে বলা হয় এর জনক। তৃণমূলের একদা হর্তাকর্তা মুকুল রায় নিজেকে অনেকটাই অনিল বিশ্বাসের আদলে তৈরি করেছেন। ওঁরা দাবি করেন, এটা রিগিং নয়, ভোট ম্যানেজমেন্ট।

প্রতি নির্বাচনে দেখা যায় বেশ কিছু ভোটারের খোঁজ পাওয়া যায় না। হয় তাঁরা মারা গিয়েছেন, ঠিকানা বদল করেছেন অথবা ভোটের সময় অনুপস্থিত রয়েছেন। এই ভোটারদের তালিকা ধরে ধরে ভোট দেওয়াকেই বলে বৈজ্ঞানিক রিগিং। ঠিক ঠিক হাতে পড়লে প্রতি কেন্দ্রে অন্তত ১০ হাজার ভোট এ ভাবে জল মেশানো সম্ভব। অনেকের ধারণা, গত বহু বছর ধরে যে কোনও নির্বাচনে ধারাবাহিক ভাবে এই জল মেশানো হয়েছে। এটাকে ব্যর্থ করতে এ বার কমিশন কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার।

কমিশনের এক কর্তা জানান, দুধে যেমন জল থাকে, চালে যেমন কাঁকর থাকে, তেমনই ভোটার তালিকাতেও ভুয়ো ভোটার থাকে। এই ভুয়ো ভোটাররাই ভূত। এই ভূতেদের খুঁজতেই আগে বাড়ি বাড়ি ভোটার স্লিপ বিলির কাজ করত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। স্লিপ বিলির সময়ই তারা বুঝে নিত, কোন বাড়ি থেকে কোন ভোটার চলে গিয়েছেন, কোন ভোটার মারা গিয়েছেন বা কোন ভোটার ভোটের দিন অন্যত্র থাকবেন। সেই সব ভোটারদের নামেই নিঃশব্দে ভুয়ো ভোট দিতে যেত তারা। বৈজ্ঞানিক রিগিং-এর সূত্রপাত সেখানেই। সেই কারণে কমিশন নিজেই ভোটার স্লিপ বিলির সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে ভুয়ো ভোটারদের খোঁজ কমিশনের কাছেই থাকে। গত কয়েকটি ভোটে এই ব্যবস্থা চালু থাকলেও এ বার ভুয়ো ভোটারদের বাছাইয়ের কাজে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে কমিশন। এ বার বিশেষ দাওয়াইও প্রয়োগ করছেন জৈদী।

কী সেই দাওয়াই? জৈদী জানান, এ বার অন্যান্য বারের চেয়েও স্বাস্থ্যকর ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকা থেকে একাধিক স্থানে নাম থাকা বা মৃত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যত্র চলে গিয়েছেন, ভোটের সময় অনুপস্থিত থাকবেন এবং মৃত ভোটারদের একটি আলাদা তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সেই তালিকা প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে জমা থাকবে। প্রয়োজনে প্রিসাইডিং অফিসার সেই তালিকায় থাকা ভোটাররা ভোট দিতে এলে বাড়তি যাচাই করবেন। এ বার প্রত্যেক ভোটারের হাতে কমিশন সচিত্র ভোটার স্লিপ পৌঁছে দেবে। যে সব ভোটার স্লিপ বিলি হবে না তা নিয়েও সতর্ক কমিশন।

জৈদী বলেন, ‘‘এ বার বিলি না হওয়া সচিত্র ভোটার স্লিপ ভোটের দিন বুথ লেভেল অফিসারের হাতে দেওয়া হবে না। রিটার্নিং অফিসারের কাছে আলাদা খামে তা জমা রাখা হবে। বিলি না হওয়া ভোটার স্লিপ ব্যবহার করে যাতে কোনও কারচুপি না হয় সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।’’

গত লোকসভা নির্বাচন এবং বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনে বিরোধী দলের এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দিয়ে ছাপ্পা দেওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে কমিশনে। বিধানসভা ভোটে এর পুনরাবৃত্তি কি ঠেকানো সম্ভব? জৈদী বলেন, ‘‘কোনও দল যাতে অন্য দলের পোলিং এজেন্টকে জোর করে বের করে দিতে না পারে প্রিসাইডিং অফিসার এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা সে ব্যাপারে নজর রাখবেন।’’ তিনি জানান, ভোটের দিন বুথে সব দলের পোলিং এজেন্টের উপস্থিতি এবং তাঁদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য কমিশন ইতিমধ্যেই কঠোর নির্দেশ পাঠিয়েছে। এজেন্টদের বুথে আসা-যাওয়া প্রিসাইডিং অফিসার ‘মুভমেন্ট শিট-এ লিখে রাখবেন। তা তিনি রিটার্নিং অফিসারকে জানাতে বাধ্য থাকবেন। প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর সেক্টর অফিসাররা যখন বুথে যাবেন তখনও এজেন্টদের কাছে থেকে ভয় দেখানো হচ্ছে কি না খবর নেবেন। এজেন্টরা প্রয়োজনে বুথের প্রিসাইডিং অফিসার, কেন্দ্রীয় বাহিনী বা বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনী অফিসারদের ফোন করেও পরিস্থিতি জানাতে পারেন। এ বার সেই সমস্ত অফিসারদের নম্বর বুথে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। এত কিছুর পরেও এজেন্টকে বের করে দিয়ে ভোট হলে কমিশন সেই সব বুথে পুনর্নির্বাচন পর্যন্ত করাতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জৈদী।

জৈদী বলেন, ‘‘এখানেই শেষ নয়, ভোটের পরের দিন পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে যে স্ক্রুটিনি হয়, সেখানে পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতির বিষয়টিও রাখা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক তা খতিয়ে দেখবেন।’’

বৈজ্ঞানিক রিগিং ঠেকানোর পাশাপাশি কমিশন অবশ্য আইনশৃঙ্খলা নিয়েও বিশেষ উদ্বিগ্ন। তাই শুধু বুথে কারচুপি ঠেকানো নয়, ভোটারদের ভয় কাটিয়ে বুথে আনতেও এ বার বদ্ধপরিকর কমিশন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE