Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বিচারক মানুষ সময়ের অপেক্ষায়

হালিশহরের সাড়ে তিন বছরের শিশুটি খবর হতে চায়নি। ওর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী কেউ চায়নি ও খবর হোক। তবু হল। হতে হল। ওর হাতের কালশিটের দাগ গণতন্ত্রের উৎসবের শরীরে যে দগদগে ঘায়ের জন্ম দিল তার প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে উৎসারিত ঘৃণা শাসকের শিরা-ধমনীতে হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছে।

তন্ময় ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ২০:৪২
Share: Save:

হালিশহরের সাড়ে তিন বছরের শিশুটি খবর হতে চায়নি। ওর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী কেউ চায়নি ও খবর হোক। তবু হল। হতে হল। ওর হাতের কালশিটের দাগ গণতন্ত্রের উৎসবের শরীরে যে দগদগে ঘায়ের জন্ম দিল তার প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে উৎসারিত ঘৃণা শাসকের শিরা-ধমনীতে হিমস্রোত বইয়ে দিয়েছে। একটার পর একটা পর্যায়ের ভোট শেষ হচ্ছে আর বিরোধী ভোটার, এজেন্ট, সাধারণ ভোটার, যাঁকে ভোট দিতে যেতে বারণ করা হয়েছিল অথচ ভোট দিয়েছেন, তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন সাধারণ মানুষ। সেই ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে পরের পর্যায়ের ইভিএম-এ।

এই মানুষ ২০১১-তে অনেক প্রত্যাশায় পরিবর্তন এনেছিলেন। বাম জমানার শেষ দিকের কিছু ভুল-ত্রুটি-দুর্বলতা-বিচ্যুতি আর তলার দিকের কিছু নেতা-কর্মী-সমর্থকের ঔদ্ধত্য, অহমিকা বহুল আলোচিত এবং পার্টি কর্তৃক ও দলিলাকারে গৃহীত। ক্ষুব্ধ মানুষকে এই আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধি সান্ত্বনা দিয়েছে। দূরে চলে যাওয়া বন্ধুকে কাছে এনেছে। ২০১৩-র পঞ্চায়েত, ২০১৪-র লোকসভা, ২০১৫-র পুরসভা ভোটের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর জোটের রাজনৈতিক বিন্যাস তাঁদের আশাবাদী করেছে। তাঁরা পরিবর্তনের হিসাব মেলাতে চেয়েছেন। মনের ভিতর উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব চেয়েছেন।

মানুষ চেয়েছিলেন, রিজওয়ানুরের মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী তাঁদের শাস্তি হোক। কিন্তু সেই সব পুলিশ অফিসারের প্রমোশন হল। মূল অভিযুক্ত বিধাননগর পুর নির্বাচনে শাসকদলের নেতার হয়ে ভোট চাইল। কেন?

নন্দীগ্রামে পুলিশের বিরুদ্ধে যে এত আন্দোলন হল তারা সবাই প্রমোশন পেল। সিবিআই রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া হল। কেন?

বাম নেতাদের দুর্নীতির তদন্ত আর জেলে পাঠানোর কিছু হল না কেন? তদন্ত কমিটি তো গড়া হয়েছিল। তার রিপোর্ট কোথায়? ৩৪ বছরে দু’শোর বেশি মানুষ মন্ত্রী হয়েছেন। এক জনের বিরুদ্ধেও কিছু পাওয়া গেল না? সারদা আর নারদে সব ভেসে গেল?

সব হাতে কাজ দেওয়ার কথা ছিল। ফ্লেক্সে ফ্লেক্সে বিজ্ঞাপন, ৬৮ লাখ চাকরি হয়েছে। মানে বুথ পিছু ৮৮ জন কাজ পেয়েছেন। কোন বুথে? ৮৮ তো দূরের কথা, আট জন কাজ পেয়েছেন এমন বুথও কি একটাও আছে? টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট নাম বদলে তৃণমূল এন্ট্রান্স টেস্ট হয়ে গেল। তাতেও চাকরি পেল মাত্র ৭ হাজার। ৩৩ হাজার শূন্যপদ পূরণ হল না কেন? কেন বার বার ফাঁস হল টেটের প্রশ্নপত্র? কেন বার বার ভুল হল এসএসসি-র বিজ্ঞাপনে? ইচ্ছাকৃত? যাতে যে কেউ মামলা করলে বাতিল হয়ে যেতে পারে পরীক্ষা?

পরবর্তী অংশ পড়তে ২-এ ক্লিক করুন

কথা ছিল খুনখারাপি বন্ধ হবে। ১৭২ জন বাম কর্মী, ৫৭ জন কংগ্রেস কর্মী, আর তৃণমূলের হাতে তৃণমূলের সিন্ডিকেট আর তোলাবাজি নিয়ে ৪৭ জনের মৃত্যু। কোন শাস্তির পশ্চিমবাংলা গড়ল?

ভোট চলছে। আবার মনে পড়ছে তাপসী মালিককে। তাঁর বহু ঘোষিত ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের বিচারের কী হল? সরকার চুপ কেন? গোটা ঘটনাটা মুখ্যমন্ত্রীর সব চাইতে পছন্দের শব্দ ‘সাজানো’ ছিল না তো? চম্পলা সর্দারের স্মৃতি উসকে উঠেছে। উল্টে গেদে থেকে গাইঘাটা, পার্ক স্ট্রিট থেকে কামদুনি, মধ্যমগ্রাম থেকে ধূপগুড়ি ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ। অর্থমূল্যে মাপা হচ্ছে মা-বোনেদের ইজ্জত। এ কোন অন্ধকারের বাংলা?

কে কিনেছিল কোটি টাকা মূল্যের ছবিটা? কেন পাঁচ বছরে আর একটাও কোটি টাকা মূল্যের ছবি আঁকতে পারলেন না? শাসকদলের জেলবন্দি এমপি-র গলার আওয়াজ ঢাকতে পুলিশ টিন বাজায় কেন? মন্ত্রীর জেলের ঠিকানা হাসপাতালের সবচেয়ে দুর্মূল্য বেড কেন হয়েছিল? জামিন রোগ কি ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির সিলেবাস থেকে পাওয়া? আর এখন তো সংবাদমাধ্যমে জানতে পারা যাচ্ছে শিক্ষামন্ত্রীর ডক্টরেট ডিগ্রিও টুকে আদায় করা! এ লজ্জা কোথায় রাখব?

সততার প্রতিমূর্তি ভেঙে খানখান হয়ে গিয়ে এখন চলছে উন্নয়নের গলাবাজি। কোথায় উন্নয়ন? মাসে দু’টাকা কিলোয় দু’কেজি চাল কার পেট ভরায়? গড়ে এক জন মানুষের মাসে দশ কেজি চাল লাগলে বাকি আট কেজি তো কিনতে হচ্ছে খোলা বাজার থেকে ৩৫ টাকা কেজিতে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই বাম আমলে দু’টাকা কেজির চাল কেউ পেতেন না। আসলে পেতেন এবং পেতেন বিপিএল তালিকাভুক্তরা। আর যে এপিএল, বিপিএলের মাধ্যমে মানুষকে বিভাজিত করা হয়েছিল সেই মন্ত্রিসভাতেও আজকের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তা সত্ত্বেও সে আলোচনায় না গেলেও আজকের ৩৫ কেজির চালটা তখন ছিল ১৮ বা ২০ টাকা কেজি। বিজ্ঞাপনের খাদ্যসাথী খাদ্যের অধিকার প্রসারিত করেনি, সঙ্কুচিত করেছে। আর কৃষক সার থেকে কৃষি উৎপাদনের দাম বৃদ্ধিতে এক দিকে দেনাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে, অন্য দিকে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমছে। কোথায় বিনা পয়সার হাসপাতাল? এক জন রাজ্যবাসীও কি আছেন যিনি এই পরিষেবা পেয়েছেন? ওষুধ, ইঞ্জেকশন, মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট, এমনকী গজ, তুলো, ব্যান্ডেজ, সিরিঞ্জ বাইরে থেকে কিনতে হয়নি? ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান রোগীদের সুবিধা না দিয়ে কয়েকটি ওষুধ কোম্পানিকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। আছে কাটমানির খেলা।

সিঙ্গুরে কারখানাও হয়নি। জমিও ফেরত হয়নি। প্রতিশ্রুতি মতো গোপন চুক্তি প্রকাশিতও হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী নীরব। কেন? কেন হলদিয়া ছেড়ে এবিজি চলে গেল? উইপ্রো, ইনফোসিস সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া ধাক্কা খেল। শালবনিতে এশিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত কারখানা একটা ছোট সিমেন্ট কারখানার চেহারা নিচ্ছে। কেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিমেন্স তার সদর দফতর তুলে নিল কলকাতা থেকে? কোথায় কাজ পাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? মুখ্যমন্ত্রীর দাওয়াই ফুচকা আর ল্যাংচা হাব। পরের প্রস্তাব কি ফুচকা তীর্থ? মানবে পশ্চিমবাংলার বেকার যৌবন?

তাই এই লড়াই কোনও দলকে জেতাবার লড়াই নয়। এই লড়াই পশ্চিমবাংলাকে বাঁচানোর লড়াই। শাসক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে পশ্চিমবাংলার মানুষের বিরুদ্ধে। তাই নৈরাজ্য, তাই গণতন্ত্র হত্যা, তাই পাড়ায় পাড়ায় সন্ত্রাস, তাই তোলাবাজি আর দাদাগিরির দাপট, তাই সিন্ডিকেট রাজের রমরমা। তাই খাগড়াগড়, তাই পিংলা, তাই নির্বাচিত এমপি-র মুখ্যমন্ত্রীর কাছে হিংস্র আবেদন, ১৯ মে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাতে বলবেন না, তাই দলের নেতার সদম্ভ ঘোষণা, ‘চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজবে।’ আর যুবরাজ ভাইপোর হুঁশিয়ারি, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়ার।

পরবর্তী অংশ পড়তে ৩-এ ক্লিক করুন

মানুষ প্রস্তুত। যত দিন এগোচ্ছে চওড়া হচ্ছে প্রতিরোধের প্রাচীর। ভোট লুঠ রুখে দিয়ে মানুষ এগিয়ে গিয়েছেন ইতিমধ্যেই নির্বাচন হওয়া কেন্দ্রগুলিতে। সরকার পতন যত অবশ্যম্ভাবী হচ্ছে, কোমরে দড়ি পড়ানোর ইচ্ছা তত আলফানসো আম হয়ে রাজ্যসভার অঙ্ক কষতে নেমেছে। একদল চায় মনুবাদী সমাজ। ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে মানুষের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দেশকে বেচতে। কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি আজ হিমঘরে। উপরন্তু লিক হয়ে যাওয়া পানামা ফাইলে দেখা যাচ্ছে, পাঁচশোর বেশি ভারতীয় শিল্পপতি, অভিনেতা, তাঁরা কর ফাঁকি দিতে বিদেশে অর্থলগ্নি করেছেন। কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী আজ পর্যন্ত তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। আর্থিক ক্ষেত্রে আঘাত হানা হচ্ছে গরিব নিম্নবিত্ত মানুষের উপর। স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হার কমিয়ে দিয়ে মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে ফাটকা বাজার বা শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে। বার বার বাড়ছে পেট্রল, ডিজেলের দাম। ফলে সারা দেশ জুড়ে জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। আর এক দল চায় পায়ের হাওয়াই চটির রঙে রাঙানো রাজ্য।

তৃণমূলী নৈরাজ্যে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা উচ্ছন্নে যাওয়ার মুখে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-অধ্যাপক, অভিভাবকরা আক্রান্ত। শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গণতন্ত্র চুরমার। নির্লজ্জ ভাবে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে শাসকদলের তাঁবেদারদের। চলছে উৎকট দলতন্ত্র। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র সংসদগুলি পুলিশের সরাসরি সাহায্য নিয়ে দখল করে নিচ্ছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। শিক্ষাঙ্গনেও গোলাগুলি ছাড়া কথা নেই তৃণমূলের। ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রহসনে পরিণত। কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুলের প্রধান শিক্ষকদেরও ক্যাম্পাসের মধ্যে শাসকদলের গুণ্ডারা শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করছে। মুখ্যমন্ত্রী সব ক্ষেত্রেই বলেছেন, ‘ছোট্ট ঘটনা’ বা ‘দুষ্ট ছেলের দুষ্টুমি’। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, শিক্ষাশ্রী— সব ভাঁওতার বিশ্রী রূপ মানুষের কাছে প্রকাশিত।

তৃণমূল জমানায় রাজ্যের আর্থিক শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। বাজেট কার্যত অর্থহীন। টাকা দরকার, ঢালাও ধার করো। মোচ্ছব করো। আর সরকারি বিজ্ঞাপনের নামে নেত্রীর ভাবমূর্তি গড়তে উড়িয়ে দাও দেদার অর্থ। কোটি কোটি টাকা খরচ করে নতুন সচিবালয় করা হয়েছে। বেহিসাবি খরচ, সরকারি অর্থের নিয়মিত তছরূপ, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা এবং অদক্ষতা, অযোগ্যতার কারণেই রাজ্য অর্থনীতির হাল বেহাল করে ছেড়েছে তৃণমূল সরকার। কীসের তাড়া তা তৃণমূলই জানে। জানে লুঠতরাজ বেশি দিন চলতে পারে না। ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছে কৃষক, দৈন্যক্লিষ্ট শতাধিক কৃষকের আত্মহত্যা বা চা শ্রমিকের মৃত্যু মিছিলে ভ্রুক্ষেপ নেই সরকারের। মাথায় বিপুল ঋণের বোঝা। অথচ ক্ষমতায় এসেই একলাফে মন্ত্রীদের বেতন ও ভাতা দশগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। চাকরি-বাকরি নেই, ক্লাবগুলোর একটি অংশকে খুশি রাখতে টাকা বিলোনোর বিশেষ কৌশল। বাছাই ক্লাবগুলোকে ভোটের আগে আরও এক দফা সরকারি অর্থ বিলোনো হয়েছে।

এর পরেও কি আমাদের কারও বোঝার বাকি থাকে, কোন ভয়ঙ্কর সর্বনাশের কিনারায় তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবাংলা ও পশ্চিমবাংলার জণগণকে নিয়ে গিয়েছে?

ইতিহাস বলে, মানুষ কারও পায়ের নীচে থাকে না। ইতিহাস জানে, মানুষ অগ্রসর হয়। পশ্চিমবাংলার প্রতি ইঞ্চি জমিতে বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির রক্তে আর ঘামে নতুন ইতিহাসের মহড়া হচ্ছে।

সেই মহড়ায় মানুষের ভূমিকা শুধু ভোটারের নয়। বিচারকের। ভোটকেন্দ্রকে দুষ্কৃতীদের হাত থেকে রক্ষা করার। রাজ্যে নতুন সরকার, মানুষের সরকার গড়ে তোলার।

সেই সরকার গড়ে ওঠা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 tanmoy bhattacharya, cpm leader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE