Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

মাছধরা থেকে ভোট, সবই তাঁর পজিটিভ

ভোটের দিন। আর তিনি কি না মাছ ধরছেন! ‘‘কী করব? আমি সারা বছর গোটা এলাকা চষে বেড়াই। ভোটের দিন বলে আলাদা কোনও চাপ নেই।’’ ভোটের দিন। আর তিনি কি না মাছ ধরছেন! ‘‘কী করব? আমি সারা বছর গোটা এলাকা চষে বেড়াই। ভোটের দিন বলে আলাদা কোনও চাপ নেই।’’

মৎস্য মারিব...। রায়দিঘিতে নিজের বাড়ির সামনে অন্য মেজাজে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। শনিবার স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

মৎস্য মারিব...। রায়দিঘিতে নিজের বাড়ির সামনে অন্য মেজাজে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। শনিবার স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

শুভাশিস ঘটক
রায়দিঘি শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০৪:১১
Share: Save:

ভোটের দিন। আর তিনি কি না মাছ ধরছেন!

‘‘কী করব? আমি সারা বছর গোটা এলাকা চষে বেড়াই। ভোটের দিন বলে আলাদা কোনও চাপ নেই।’’

সত্যিই তাই। রায়দিঘির উত্তর কুমড়োপাড়া গ্রামের বাড়ির পুকুরে সকাল থেকে ছিপ ফেলে বসে রইলেন সিপিএম প্রার্থী তথা প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। প্রশ্নটা যখন করি, তখন বেলা সাড়ে আটটা। প্রায় দেড় ঘণ্টা ভোট হয়ে গিয়েছে। তিনি কিন্তু নির্বিকার। কিছু ক্ষণ পর ছিপে উঠল একটা চারাপোনা! সেটাকেই বেশ কায়দা করে খেলিয়ে তোলার সময় মুচকি হেসে বললেন, ‘পজিটিভ’। মাছটা একটা লাল প্লাস্টিকের বালতিতে রেখে দিলেন।

কিন্তু কাঁহাতক আর মাছ ধরে সময় কাটানো যায়? তার উপর গরমও বাড়ছে। অগত্যা একতলার ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে শুরু করলেন একের পর এক ফোন। ও-পাশ থেকে আসা কথাগুলো শুনতে শুনতে এক বার বললেন ‘‘এজেন্ট বসতে দিচ্ছে না তো কী হয়েছে? তুমিও তো নেতা। তুমি এজেন্ট হয়ে বসে পড়ছ না কেন? শুধু নালিশ কেন।’’ এক বার বললেন, ‘‘দেখিস বাবা, সকলে যেন ভোটটা ঠিকমতো দিতে পারে।’’ পাশাপাশি টুকিটাকি নির্দেশও। কাউকে বলছেন, ‘‘জলটা বেশি করে খাস, পারলে একটু নুন-চিনি মিশিয়ে।’’ কাউকে ধমক, ‘‘কত বড় নেতা তুমি যে বয়স্ক ভোটারদের হাত ধরে বুথে আনতে লজ্জা পাচ্ছ?’’

ভোটের দিন আপনি এ ভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরেই বসে থাকবেন? দেবশ্রী রায় তো গোটা এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন গাড়ি চড়ে। মুচকি হেসে কান্তিবাবুর জবাব, ‘‘এই এক দিনই তো! আমি তো সারা বছর রায়দিঘি চষে বেড়াই।’’ দোতলার ঘরে বসে কান্তিবাবুর ছেলে তথা মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট সাম্য গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু এতটা নিশ্চিত হতে পারেননি। গত বারের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে সকাল থেকে বিকেল অবধি প্রতিটি বুথের খোঁজ নিয়েছেন। কোথাও ফোন করে, কোথাও বাইকে চড়ে পৌঁছে গিয়ে। আর কান্তিবাবু মোবাইলে জেলার একের পর এক বিধানসভার ভোট পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন। মাঝে এক বার অল্প খই দিয়ে টক দই খেয়ে বিশ্রাম। তার মধ্যেই বেলা ১২টা নাগাদ খোঁজ নিলেন নিজের কেন্দ্রে কোথায় কত ভোট পড়েছে। ভোট ম্যানেজারেরা জানালেন, প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই স্থানীয় এক সিপিএম নেতা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘‘যত বেলা বাড়ছে, তৃণমূল এজেন্টরা ঝিমিয়ে পড়ছে।’’ কান্তিবাবুর মুচকি হাসি, ‘‘এক দিকে গরম, অন্য দিকে কেন্দ্রীয় বাহিনী। ওরা টি-টোয়েন্টি (ছাপ্পা) খেলতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছে!’’

বেলা প্রায় ১টা। হইহই করে কয়েক জন সিপিএম কর্মী দরজা
খুলে ঢুকে পড়লেন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর তাড়ায় মাটিতে পড়ে হাত-পা ছড়ে গিয়েছে। কান থেকে ফোন সরিয়ে কান্তিবাবুর কড়া ধমক, ‘‘বুথের সামনে জটলা করলে এমনই দশা হবে। কেন্দ্রীয় বাহিনী মানুষের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। ওরা যা করেছে ঠিকই মনে হচ্ছে। তোমরা বুথের কাছে বেশি থেকো না। বরং যাঁরা আমাদের ভোটার, এখনও ভোট দিতে যাননি, তাঁদের বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে ভোট করানোর ব্যবস্থা কর। হয়তো কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভয়ে অনেকে বুথে যেতে ভয় পাচ্ছেন। নিজেরাই যদি ভয় ছড়িয়ে দাও তো অন্যদের কী হবে?’’

বেলা প্রায় দুটো। একে একে সবাইকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে বলে ফোন ও কাগজপত্র নিয়ে বসে গেলেন। ফোনে একের পর এক বুথের খবর নিয়ে একটা সাদা কাগজে শতাংশের হিসেব লিখে নিলেন। মাঝে এক বার টিভির সামনে গিয়ে বসলেন। পরপর খবরের চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে খোঁজ নিলেন কলকাতা ভোটের। একটু পরে এক ভোট ম্যানেজারকে ফোন— ‘‘দেবীপুর ও নালুয়া পঞ্চায়েত এলাকায় মনে হয় আমাদের ভোট ভাল হচ্ছে না।’’ তা হলে? ‘‘আরে বাকি সব এলাকায় আমাদের ভাল ফল হবে।’’ তার পর ডাল-ভাত-মাছের ঝোল খেয়ে ফের পুকুর পাড়ে হাজির কান্তিবাবু। ফাতনা তখনও ভাসছে। প্লাস্টিকের বালতিতে দু’টি মাত্র মাছ। দু’টিই চারাপোনা! ধুস্! ছিপে চার গেঁথে ফের পুকুরের জলে ছেড়েই বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমেই উত্তর কুমড়োপাড়ার বুথে, নিজের ভোটটা দিতে। বুথে ঢুকেই বিরোধী দলের এজেন্টের পিঠে হাল্কা টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘খাওয়া হয়েছে?’’ হয়েছে শুনে পোলিং অফিসারদের কাছ থেকে ভোটের শতাংশের হিসেব নিলেন। বুথ থেকে বেরিয়ে কর্তব্যরত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। কোথা থেকে এসেছেন, কোথায় কোথায় ভোট করলেন, সব খবর নিলেন। জওয়ানরাও ঘিরে ধরে গল্প শুরু করে দিলেন।

দিনের শেষে বাড়িতে ঢোকার মুখে এক এজেন্টের সঙ্গে দেখা। ‘‘তোর ওখান থেকে হাজার আড়াই লিড হবে?’’ এজেন্ট ঘাড় চুলকে বললেন, ‘‘দাদা, দু’হাজার মতো হবেই।’’ শুনে মুচকি হেসে বললেন, ‘‘যদি দু’হাজার লিড হয়, তা হলে তোর আমি আবার বিয়ে দেব! বলেছিলি না, আর একটা বিয়ে করবি!’’ বলেই হো হো করে হাসি। এজেন্ট তখন লজ্জায় পালাতে পারলে বাঁচেন।

বাড়ি ঢুকেই পুকুর পাড়ে। ছিপের ফাতনা জলে ডুবে। ছিপ ধরে টান দিতেই উঠে এল প্রায় আধ-কেজির একটি কাতলা। কান্তিবাবুর মুখে মুচকি হাসি। বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘সকাল থেকে সব পজিটিভ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE