Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ঝামেলা নেই তো? বুদ্ধের ফোন দীপাকে

স্করপিও এগোচ্ছে এলগিন রোড ধরে। ‘বৌদির’ মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘মানব মুখার্জি-সিপিএম’। ফোন ধরতেই, ওপার থেকে বলা হল, ‘‘নমস্কার, ধরুন বুদ্ধবাবু কথা বলবেন!’’ ‘‘বুদ্ধবাবু, হ্যাঁ দিন ওনাকে।’’ বেশি কথা নয়। অথচ তার মধ্যেই যেন মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল জোটের ছবিটা। যে ছবি দেখা গিয়েছিল পার্ক সার্কাস ময়দানের সভায়। রাহুল গাঁধী-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে যেখানে এক মঞ্চে ছিলেন দীপা দাশমুন্সি।

প্রাক্তন ও বর্তমান। ভোট দিয়ে বেরোচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। (ডান দিকে) বুথের পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার দক্ষিণ কলকাতায় সুমন বল্লভ ও সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।

প্রাক্তন ও বর্তমান। ভোট দিয়ে বেরোচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। (ডান দিকে) বুথের পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার দক্ষিণ কলকাতায় সুমন বল্লভ ও সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।

দেবারতি সিংহ চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০৪:২৭
Share: Save:

স্করপিও এগোচ্ছে এলগিন রোড ধরে। ‘বৌদির’ মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ‘মানব মুখার্জি-সিপিএম’। ফোন ধরতেই, ওপার থেকে বলা হল, ‘‘নমস্কার, ধরুন বুদ্ধবাবু কথা বলবেন!’’

‘‘বুদ্ধবাবু, হ্যাঁ দিন ওনাকে।’’ বেশি কথা নয়। অথচ তার মধ্যেই যেন মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল জোটের ছবিটা। যে ছবি দেখা গিয়েছিল পার্ক সার্কাস ময়দানের সভায়। রাহুল গাঁধী-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে যেখানে এক মঞ্চে ছিলেন দীপা দাশমুন্সি।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জানতে চাইলেন, ‘‘কেমন চলছে? সব ঠিক আছে তো!’’ বেলা তখন পৌনে বারোটা। দু’টো বুথে ইভিএম খারাপ হওয়া ছাড়া তখনও তেমন কোনও ত্রুটির খবর পাননি ভবানীপুরের জোট প্রার্থী দীপা। বুদ্ধদেববাবুকে সেটুকুই জানালেন।
তবু ভরসা এলো ওপার থেকে,-‘‘কোনও গণ্ডগোল হলে আমাকে তক্ষুনি জানাবেন।’’

শনিবার দুপুরে এই শুরুর আগে একটা শুরু ছিল। ‘দিদি’-কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দীপা ভবানীপুরে লড়তে রাজি হওয়ার পর পরই তাঁকে সস্ত্রীক বুদ্ধবাবু অভিনন্দন জানিয়েছেন। তার পরও কথা হয়েছে পার্ক সার্কাসের মঞ্চে। তবু এ দিনের ফোনটার মাত্রা অন্য। যেন অক্সিজেনে ভরপুর।

এলগিন পিছনে ফেলে গাড়ি এগোতেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের দিকে হাত নাড়তে গিয়ে কাচ নামালেন দীপা। আরও কিছুটা ফুরফুরে হাওয়া ঢুকলো ভিতরে। মাথার উপর মেঘও তখন ছায়া ফেলেছে। বৃষ্টি হবে নাকি?

কৌতূহল মেটাতে মোবাইলের অ্যাকু-ওয়েদারে চোখ বুলিয়ে নিমেষে স্বস্তিতে দীপা বলেই ফেললেন, ‘‘নাহ্! বৃষ্টি না। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ঝড় উঠবে দেখছি! ভবানীপুরের ভোটে ঝড় উঠবে তা হলে?’’

রোদ-মেঘের লুকোচুরি দেখতে দেখতেই সকাল সাড়ে ছ’টায় রানি ভবানী রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দীপা। ভবানীপুরের অলি-গলিতে চরকিপাক ঘুরে
বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ একবালপুরের ইব্রাহিম রোডে যখন থামে তাঁর গাড়ি, তখন সামনে লোকের জটলা। রয়েছে পুলিশের ভিড়ও। কী হল, বুঝতে একটু এগোতেই দীপাকে ঘিরে ধরে
জোট-কর্মীদের উত্তেজনা, ‘‘বৌদি, দু’টো ছেলে বোমা রেখে পালিয়েছে। পুলিশ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই বোমা উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছে।’’

কর্মীদের আশ্বস্ত করে কিছু ক্ষণ তাঁদের সঙ্গে কথা বলে দীপা এগোলেন খিদিরপুরের কার্ল মার্ক্স সরণির দিকে। তার মাঝেই খবর এলো শাসক দলের লোকজন কোথাও কোথাও জটলা বাড়াচ্ছে। দ্রুত কালীঘাট রোডে সিপিএমের পার্টি অফিসের কন্ট্রোল রুমে তাঁর ভোট-ম্যানেজার পল্টু রায়চৌধুরীকে নির্দেশ দিলেন বৌদি, ‘‘এখনই কমিশনকে জানান পল্টুদা।’’

দিনভর বুথে বুথে ঘোরার সময় কত যে পরিচিতের সঙ্গে দেখা হল ইয়ত্তা নেই। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার রাজনীতি বা ব্যক্তিগত জীবনে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বন্ধু ছিলেন। যেমন খালসা হাইস্কুলে সপরিবার এক পাঞ্জাবি বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তাঁর। দীপাকে তিনি বললেন, ‘‘প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে হাজরা ল’কলেজে পড়েছি। অনেক বছর পরে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ায় ভাল লাগছে।’’

হাসি মুখে। ভবানীপুরের এক ভোট কেন্দ্রে প্রার্থী দীপা দাশমুন্সি। শনিবার সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

একই ভাবে এলগিন রোডে তাঁকে দেখে গাড়ি থামালেন এক প্রিয়-অনুরাগী। আবার দীপার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় হল রাস্তার মোড়ে মোড়ে কর্তব্যরত পুলিশেরও। কেউ তাঁকে দেখে হাত নাড়লেন। কেউ বা শুধুই নমস্কার। কোথাও দীপাকে বুথে ঢুকতে দেখে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘কোনও গোলমাল ছাড়াই ভোট হচ্ছে ম্যাডাম।’’

দক্ষিণ কলকাতায় প্রথম বার লড়াইয়ের ভোটে দিনভর দীপার মনেও ভিড় করল প্রিয়-স্মৃতি। ভোট মিটতেই বললেন, ‘‘আগে তো ভোটের দিন একটা দিক আমি ঘুরতাম, অন্যদিক প্রিয়দা। এখন আমি একা ঠিকই! কিন্তু মানুষের কাছে ওঁর কথা শুনে মনে হচ্ছিল, হাসপাতালে শুয়ে থাকলেও প্রিয়দা আমার সঙ্গেই ছায়ার মতো ঘুরলেন।’’

দিনান্তে কালীঘাটের পার্টি অফিসের টিভিতে চোখ রেখে দীপা ধন্যবাদ দিলেন পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। বললেন, ‘‘চৌরঙ্গি আর সল্টলেকের ভোট দেখে বুঝেছিলাম ভবানীপুরের ভোটে গোলমাল হবে না।’’

সারা দিন ঘুরলেও রাতে ক্লান্তির লক্ষণ দেখা যায়নি প্রিয়-পত্নীর মধ্যে। চলে গেলেন শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে। দীপার নিজের ওই স্কুলই যে ভবানীপুরের স্ট্রং রুম। বললেন, ‘‘ইভিএম সিল করে স্ট্রং রুমে তালা পড়ছে, এটা না দেখে আমি ভোটের দিন ঘুমোতে পারি না।’’

দেড় মাস ভবানীপুরের মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেও লড়াইটা যে সত্যিই কঠিন, তা মেনে নিচ্ছেন মেনে নিচ্ছেন দীপাও। পূর্বাভাস থাকলেও বিকেল পেরিয়ে রাতে ঝড় আসেনি কলকাতায়। ভবানীপুরে বড় গোলমালের খবরও নেই। বুদ্ধবাবুকে তাই ফোন করতেও হয়নি।

তবু ফোনটা তো ভরসা দিল। লড়াইয়ের। বাম ভোট পাওয়ারও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE