Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শহরেই ব্রাত্য বহরমপুরের নাট্যদল

মরেও মরে না, এমনই শত্রু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলার নাট্যজগত। বাংলা নাটকের মক্কা যদি হয় কলকাতা, বহরমপুর তবে মদিনা। প্রায় দু’শো বছরের নাটকের ঐতিহ্যে সম্ৃদ্ধ সেই বহরমপুরেই পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত ‘অন্তর্বঙ্গ নাট্য উৎসব’-এ ডাক পেলেন না শহরের কোনও নাট্যসংস্থা। রবীন্দ্রসদনে পাঁচদিনের এই উৎসবে ব্রাত্য রইল বহরমপুর।

রবীন্দ্রসদনের সামনে টাঙানো সেই ব্যানার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

রবীন্দ্রসদনের সামনে টাঙানো সেই ব্যানার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

অনল আবেদিন
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:০২
Share: Save:

মরেও মরে না, এমনই শত্রু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলার নাট্যজগত।

বাংলা নাটকের মক্কা যদি হয় কলকাতা, বহরমপুর তবে মদিনা। প্রায় দু’শো বছরের নাটকের ঐতিহ্যে সম্ৃদ্ধ সেই বহরমপুরেই পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি আয়োজিত ‘অন্তর্বঙ্গ নাট্য উৎসব’-এ ডাক পেলেন না শহরের কোনও নাট্যসংস্থা। রবীন্দ্রসদনে পাঁচদিনের এই উৎসবে ব্রাত্য রইল বহরমপুর।

অথচ শহরের বহু নাট্যদল দেশের বিভিন্ন রাজ্য তো বটেই, বাংলাদেশ, নেপালেও একাধিক বার নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। তাহলে ঘরের পাশের উৎসবে তাঁরা নেই কেন? নাট্যদল থেকে নাট্যরসিক দর্শক, সকলেরই অভিযোগ, শহরের নাট্যদলগুলি নাট্যস্বজনের সদস্য নয় বলেই এই উপেক্ষা। কিন্তু নাট্যস্বজন তো ভেঙে গিয়েছে? নাট্যজনের ব্যাখ্যা, কর্তা মারা গিয়েছেন, কর্তার ভূত ঘাড় থেকে নামেনি। নাট্যস্বজন-কর্তার ভূত এখনও তাড়া করছে রাজ্যের নাট্যজগৎকে।

তবে ঘাড় গুঁজে এই অসম্মান মেনে নেয়নি বহরমপুরও। বহরমপুরের নাট্যকর্মীরা বহরমপুর রবীন্দ্রসদনের প্রধান ফটকের সামনে টাঙিয়ে দিয়েছেন ব্যানার, ‘পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির নাট্যমেলায় বহরমপুরের নাট্যপ্রযোজনা উপেক্ষিত কেন?’ সরকারি ওই নাট্য উৎসবেকে কার্যত বয়কট করেছেন বহমপুরের নাট্যরসিক মহল। ফলে সাড়ে ছ’শো আসনের যে রবীন্দ্রসদনে নাটক দেখতে হামেশাই ভিড় উপচে পড়ে, দর্শক সামলাতে বাড়তি চেয়ারের ব্যবস্থা করতে হয়, সেখানে সরকারি নাট্য উৎসবের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় দর্শক-পুলিশ-আমলা-আয়োজক মিলিয়ে উপস্থিত ছিলেন সাকুল্যে ৬০ জন। দর্শকরা যে সরকারি নাট্য উৎসবকে ‘বয়কট’ করেছেন সে কথা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছেন সরকারি কর্তারাই।

দর্শক সংখ্যার শোচনীয় হাল দেখে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির প্রশাসনিক কর্তা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বুধবার মঞ্চ থেকে বলেন, “বহরমপুরে নাটকের খুব ভাল দর্শক আছে বলে জানতাম। নাট্য উৎসবের প্রচারও হয়েছে যথেষ্ট। তবুও কেন যে দর্শক এত কম বুঝতে পারছি না।” মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) সন্দীপ দত্ত রীতিমতো পরিসংখ্যান তুলে বলেন, “অন্য উৎসবে দর্শকের ভিড়ে রবীন্দ্রসদন উপছে পড়ে। আর আজকে দশ ভাগের এক ভাগ দর্শকও হল না।” তাঁর পরামর্শ, “হুইসপার ক্যাম্পেন করুন, যাতে আগামী দিনে দর্শক আসে।”

কিন্তু তাতেও ভবি ভুলবার নয়। বৃহস্পতিবারও দর্শক সংখ্যার অপ্রতুলতার কলঙ্কমোচন হয়নি। তার কারণ কী? ৪১ বছরের প্রাচীন ও আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বহরমপুরের নাট্যসংস্থা ‘যুগাগ্নি’র প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ সরকার বলেন, “বহরমপুরের নাট্যদল থাকলে তো বহরমপুরে দর্শক থাকতো। কিন্তু বহরমপুরের কোনও দলকে তো ডাকাই হয়নি।” তার বদলে আনা হয়েছে বেশ কিছু অনামি নাট্যদললকে, যাঁরা নাট্যস্বজনের ‘কোলঘেঁষা’ বলে অভিযোগ শহরের নাট্যদলের একাংশের।

ওই উৎসবে অংশগ্রহণ করা মোট সাতটি দলের মধ্যে অবশ্য কলকাতার দু’টি দল রয়েছে, যাঁরা নাট্যস্বজনের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান করেন না। কিন্তু সেখানেও হতাশা। কারণ, তাদের একটি দলের যে নাটকটি সমাপ্তি সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ করা হবে, তা মাত্র ৪১ দিন আগে এই একই মঞ্চে ঋত্বিকের নাট্যমেলায় দেখা গিয়েছে। তাতে আরওই বিমুখ হয়েছেন শহরের দর্শক। বারবার একই নাটক দেখতে তাঁরা আসবেন কেন?

বহরমরপুরের ঋত্বিক, ছান্দিক, যুগাগ্নি, রেপার্টরি, প্রান্তিক ও রঙ্গাশ্রমের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠিত বহরমপুরের নাট্যদলগুলি কেবল মুম্বই, ভূপাল, ওড়িশা, দিল্লির মতো বিভিন্ন রাজ্যেই নয়, একাধিকবার আমন্ত্রিত হয়ে বিদেশের মাটিতেও যথেষ্ট প্রশংসার সঙ্গে মঞ্চস্থ করেছে নানা নাটক। অথচ তাঁরাই ঘরের পাশের মঞ্চে ডাক পেলেন না। ঋত্বিকের সম্পাদক মোহিতবন্ধু অধিকারী ও ছান্দিকের কর্ণধার শক্তিনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা বহরমপুরের কোনও নাট্যদল কোনও রাজনৈতিক শক্তির কাছে দাসখত লিখে দিইনি। তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সরকারি উৎসব থেকে বহরমপুরের নাট্যদলগুলিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাতে অন্তর্বঙ্গ নাট্য উৎসবটাই হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

বহরমপুরে অনুষ্ঠিত অন্তর্বঙ্গ নাট্য উৎসবে বহরমপুরকেই ব্রাত্য করে রাখা হল কেন? রঘুনাথগঞ্জের একটি অখ্যাত নাট্যদলের নাম করে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির প্রশাসনিক কর্তা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কেন? ওই যে রঘুনাথগঞ্জের একটি দল রয়েছে এই উৎসবে।”

নাট্যস্বজনের আশীর্বাদপুষ্ট স্বল্প পরিচিত ওই দলটির বয়স তৃণমূল পরিচালিত সরকারের বয়সের থেকেও কম বলে রঘুনাথগঞ্জের অনেকের দাবি। এর আগে একটি সংবাদপত্রে দেবীপ্রসাদবাবু লিখেছিলেন, “জেলার নাটক দেখার জন্য তো অন্তর্বঙ্গ নাট্য উৎসবের আয়োজন রয়েছে।” এ বার বহরমপুরে দেখা গেল, অন্তর্বঙ্গ নাট্য উৎসবের আয়োজন রয়েছে ঠিকই, তবে সেখানে বহরমপুরের নাটক নেই। নেই দর্শকও। অশরীরী আত্মার মতো আছে, কেবল নাট্যস্বজন-কর্তাদের উপস্থিতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anal abedin play berhampore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE