মার্কিন বৌয়ের সামনে নিজের শহর চেনাতে এসে রীতিমতো অপ্রস্তুত দেড় দশকের প্রবাসী যুবক। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহল্লা বো ব্যারাকের ‘আন্টি’রা যে নিখাদ ছানা দিয়ে এমন দেবভোগ্য কেক তৈরি করেন, তা আজন্ম এ শহরে কাটিয়েও জানা হয়নি তাঁর।
শহরের নামী স্কুলের ইতিহাসের মাস্টারমশাইও কি জানতেন, কাঠখোট্টা কংক্রিট-নগরীর মধ্যে কোথায় লুকিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংসের বিখ্যাত ডুয়েল-যুদ্ধ স্মৃতি? কিংবা কোথায় আছে সিরাজ বনাম কোম্পানির টক্করে বন্দি ইংরেজদের ‘ব্ল্যাক হোল-বিপর্যয়’-এর স্মারক?
সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরীটি দেখতে এখনও আসেন দূর দেশের পর্যটকেরা। তবু কুমোরটুলির ঘুপচি গলির ঐশ্বর্য, শহরের বাজারের বর্ণময়তা বা অফিসপাড়ার ইতিহাসের পরত রাত-দিন নেট ঘেঁটেও অনেকের কাছেই অধরা থেকে গিয়েছে।
কলকাতার ভিতরের এই ‘আর একটি কলকাতা’ চেনাতেই এখন সামিল কিছু শহরবাসী। অলি-গলি হেঁটে শহরের স্বাদ-গন্ধের ছোঁয়া পৌঁছে দেওয়াটাই তাঁদের কাজ। কাছের-দূরের পর্যটক তথা কলকাতা-সন্ধানীদের কাছে যাঁরা ক্রমশ বড় ভরসা হয়ে উঠছেন।
পোশাকি নাম ‘হেরিটেজ ট্যুর গাইড’। তবে চিরকালের ট্যুর গাইডদের সঙ্গে ফারাক আছে। ‘‘স্রেফ কয়েকটি বাঁধাধরা ট্যুরিস্ট স্পট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা জাদুঘরে আটকে থাকি না। পর্যটকদের বন্ধু হয়ে তাঁদের এই শহরের স্বাদ-গন্ধ-রং চেনাতে চাই,’’ বলছিলেন মনোজিৎ সিংহ হুনজান। ‘ক্যালকাটা ফোটো ট্যুর’ সংস্থার তরফে শহর চেনানোর নানা ট্যুর আয়োজন করেন ৪৩-এর যুবক। ‘ক্যালকাটা হেরিটেজ ওয়াক’ সংস্থার ঋত্বিক ঘোষ আবার বলছিলেন, ‘‘শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা বেলুড় মঠ মানেই তো কলকাতা নয়। ছোট ছোট সফরে এই শহরের নানা সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার রংগুলো আমরা চেনাতে চাই।’’
সরকারি উদ্যোগে শহর ঘুরিয়ে দেখানোর কয়েকটি ‘ট্যুর’ অবশ্য আছে। তবু এ ধরনের ‘হেরিটেজ ওয়াক’-এর যে আলাদা মাত্রা, তা মানেন পর্যটন-বিশেষজ্ঞেরা। কেন্দ্রীয় সরকারের গঠিত স্বশাসিত সংস্থা ইনট্যাকের কলকাতা চ্যাপ্টারের আহ্বায়ক গৌরমোহন কপূরের কথায়, ‘‘বাসে চড়ে কনডাক্টেড ট্যুরে শহর চেনা যায় না। পায়ে হেঁটে শহর চিনতে উৎসাহ দেওয়া হয়।’’ ইনট্যাক-এর স্বেচ্ছাসেবীরাই দু’দশক আগে কলকাতায় হেরিটেজ ওয়াক
চালু করেছিলেন।
ঘণ্টা তিনেকের সফর। কোনওদিন হয়তো চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে রবীন্দ্র সরণি ধরে বেড়ানো। কলকাতার সাবেক চিনে মহল্লা, অ্যাংলো পাড়া, ইহুদি সিনাগগ, উর্দুভাষী মুসলিম মহল্লা বা বড়বাজারে মারোয়া়ড়িদের তল্লাট চিনে নেওয়া। উত্তরের সাবেক বাবু-কালচারের স্বাদ পেতে শোভাবাজার, বাগবাজার, কুমোরটুলিও ঢুঁড়ে ফেলা যেতে পারে। কিংবা একদিন কলকাতার স্ট্রিট ফুডের টানে হতে পারে একটা ফুডওয়াক। হয়তো নিজামের রোল, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাংলাদেশি খানার ঠেকের ভর্তা-পাতুরি বা রাসেল স্ট্রিটের ঝালমুড়ি, বরদান মার্কেট পাড়ার পাওভাজি চেখে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে হেঁটে বেড়ানো।
আজ, শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়দের পরিচালিত ছবি, ‘প্রাক্তন’। তারই সৌজন্যে এই ‘হেরিটেজ ট্যুর গাইড’রা এখন নজর কা়ড়ছেন। এই ছবিতে উজান (প্রসেনজিৎ) এক জন হেরিটেজ ট্যুর গাইড। সংরক্ষণ স্থাপত্যবিদ সুদীপার ভূমিকায় ঋতুপর্ণা। হেরিটেজ ট্যুর গাইডদের চালচলন রপ্ত করতে ঋত্বিকের কাছেই নাড়া বেঁধেছিলেন প্রসেনজিৎ।
শিবপ্রসাদদের ছবিতে হেরিটেজ ওয়াক-এর মাধ্যমে কলকাতা শহরও একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে। ডেকার্স লেনের চিকেন স্ট্যু, অফিসপাড়ার ‘সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ বিল্ডিং’, সেন্ট জনের গির্জা চত্বর, আলিপুরের পুলিশ লাইনের নানা ইতিহাস জলজ্যান্ত এই ছবিতে। শহরের পটভূমিতে ছবি হওয়ায় কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় খুব খুশি। বলেন, ‘‘ছবিটি দেশে-বিদেশে দর্শকদের সামনে শহরে ইতিহাস, সৌন্দর্য তুলে ধরলে তো খুব ভাল। পর্যটকেরা নিশ্চয়ই কলকাতায় আসতে উৎসাহী হবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy