‘মওকা মওকা’ বিজ্ঞাপনের একটি দৃশ্য। স্টার স্পোর্টসের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
মাত্র এক-দেড় দিনের মধ্যে বানাতে হচ্ছে একেকটা আস্ত বিজ্ঞাপনী ছবি। টিভিতে বিশ্বকাপের ফাঁকে সেগুলো দেখেই সকলে গাইছেন, “মওকা, মওকা...।”
এ বারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের ঠিক আগে ৬ মার্চ মুক্তি পেয়েছিল এই ‘মওকা’ সিরিজের প্রথম বিজ্ঞাপন। এক দিনের মধ্যেই ইউটিউব হিট দশ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। তার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোর বেগে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওটি। হ্যাশট্যাগ বেয়ে ‘মওকা মওকা’ আলোড়ন ফেলে পড়শি পাকিস্তানের নেট-দুনিয়াতেও। এখন ভিডিওটির ইউটিউব হিট প্রায় ২৫ লক্ষ!
মওকা সিরিজের প্রথম ক্যাম্পেনে দেখা যাচ্ছিল এক পাকিস্তানি ভদ্রলোককে, যিনি যৌবন পার করে শিশুপুত্রের সঙ্গে ম্যাচ দেখছেন। তবুও ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের জয় দেখতে পাননি। অধীর আগ্রহে তিনি অপেক্ষা করেন বাজি পোড়ানোর ‘মওকা’ পাওয়ার। এর পরে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আয়ার্ল্যান্ড ম্যাচের আগেও ‘মওকা’ সিরিজের নতুন বিজ্ঞাপন সমান জনপ্রিয় হয়। জনপ্রিয়তার জোর এমনই যে, বহুজাতিক অনলাইন শপিং ব্র্যান্ডের সেলের নামও এখন দেওয়া হচ্ছে ‘মওকা সেল’! সোশ্যাল মিডিয়ার ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য রেসপন্স ভিডিও, স্পুফ। পাকিস্তান থেকে পাল্টা ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের আগে দু’দেশের সমর্থকেরাই ‘মওকা’ গানের সঙ্গে ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে ছেড়েছেন। বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, জনগণও অজান্তেই সমান্তরাল ভাবে বিপণনে অংশ নিয়ে চলেছেন। এটাই সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে বিপণনের সুবিধা, যা শুরু হয়েছে ইন্টারনেট বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে।
বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ শৌভিক মিশ্র মনে করিয়ে দিচ্ছেন রোমানিয়ার বিখ্যাত ‘রম চকোলেট ক্যাম্পেনের’ কথা। রোমানিয়ার জাতীয় পতাকার রঙে ছিল চকোলেটের মোড়ক। তারা হঠাৎই তা বদল করে আমেরিকার পতাকার রঙে মোড়ক তৈরি করে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সরব হন মানুষ। তাঁদের দাবি, পুরনো মোড়কই ফিরিয়ে আনতে হবে। আসলে পুরোটাই ছিল বিজ্ঞাপনী-কৌশল। শৌভিক বলছেন, “মওকা মওকার মধ্যে দিয়েও কৌশলে দেশবাসীর অহংবোধ ও দেশাত্মবোধকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে। সেই অনুভূতি থেকেই তাঁরা মূল বিজ্ঞাপনকে ভিত্তি করে নিজেরা অজস্র ভিডিও তৈরি করছেন, যেটাই আসলে ক্যাম্পেনটার সাফল্য।”
আগেকার দিনের চেয়ে ইন্টারনেট-যুগের প্রচারকৌশলের ফারাক এটাই। জনগণের যোগদান। মুম্বইয়ের বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ রঘু ভট্ট বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সকলেরই নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম রয়েছে। তাই ব্র্যান্ডগুলো জনগণের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাক্টিভ বিজ্ঞাপনের উপরেই এখন বেশি জোর দিচ্ছে। এমনিতে কোনও বড় টুর্নামেন্ট ঘিরে বরাবরই নানা ক্যাম্পেন সিরিজ করে থাকে নানা ব্র্যান্ড। ২০০৩ বিশ্বকাপের সময় ১৯৮৩-র স্মৃতি উস্কে দিয়ে ‘বিশ সাল বাদ’ ক্যাম্পেন জনপ্রিয় হয়েছিল। সেখানে সৌরভ, হরভজন, জাহির-সহ ২০০৩-এ ভারতীয় দলের একাধিক সদস্যের ১৯৮৩-র ছবি দেখিয়ে ২০ বছর পরে বিশ্বজয়ের আকাঙ্খা চাগিয়ে তোলা হতো। দর্শকের মনে থেকে গিয়েছে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সময় ঠান্ডা পানীয়ের ‘নাথিং অফিসিয়াল অ্যাবাউট ইট’ ক্যাম্পেনও। “বিশ্বকাপের অফিসিয়াল পানীয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডের এই বিজ্ঞাপন ভারতে হওয়া অন্যতম সেরা সিরিজের একটি”, মত রঘুর। কিন্তু ‘মওকা’ যে একটা নতুন ট্রেন্ড শুরু করল, সে বিষয়ে কারওরই দ্বিমত নেই।
কী রকম? প্রত্যেকটা ম্যাচের আগে নতুন গল্প নিয়ে আসে ‘মওকা’। ফলে নতুন ম্যাচ দেখার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ‘মওকা’ কী বলছে, সেটার জন্যও মুখিয়ে থাকেন দর্শক। বুধবার যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের ফাঁকে দেখা গিয়েছে রণবীর কপূরকে। তিনি বলছেন, তাঁর আগামী ছবি ‘বম্বে ভেলভেট’-এর ট্রেলার দেখতে হলে দেখতে হবে আজকের ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ। তারপরেই গেয়ে উঠছেন, “মওকা মওকা...”
বিজ্ঞাপনটির পরিচালক সুরেশ ত্রিবেণী বলছিলেন, “নিজেদের মনে হচ্ছে যুদ্ধের সৈনিকের মতো। অনেকটা সে রকম দ্রুততার সঙ্গেই ভিডিওগুলো বানানো হচ্ছে।” একটা ম্যাচ শেষ হলেই শুরু হয়ে যাচ্ছে পরের ম্যাচের জন্য ব্রেনস্টর্মিং। ভারত জিতলে কী হবে, হারলে কী হবে দু’রকম গল্পই ভেবে রাখতে হচ্ছে। সুরকার জুটি রোহন-বিনায়কের সুরে মওকা-র গানটি গেয়েছেন আলমগীর খান। রোহন বললেন, “আমরা চেয়েছিলাম কেউ একটা জিনিস খুব আশা নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এই মেজাজটা যেন থাকে। তাই সিদ্ধান্ত নিই সুফি কাওয়ালি ও রক মিশিয়ে সুর দেওয়ার।”
লোকজনের মুখে মুখে ফেরাটাই যে তাদের সাফল্য, তা মানছে স্টার স্পোর্টসও। সংস্থার মুখপাত্র বলছেন, “পাকিস্তান থেকে মওকা-র প্রথম রেসপন্স ভিডিও তৈরি হয়। একটা বিজ্ঞাপনের জেরে যে দু’দেশের মানুষজনের মধ্যে একটা আনন্দের আদানপ্রদান হচ্ছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
বৃহস্পতিবার ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে কে ‘মওকা’ পেয়ে বাজিমাত করে, তা সময় বলবে। তা নিয়ে বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনা কী? সংস্থার প্রযোজক কেতকী গুহগরকর সুর্ভে শুধু বলছেন, “এ বারের বিজ্ঞাপন মেজাজে আরও বড়।” চমকটা ভাঙলেন না সুরেশ। শুধু হেসে জানালেন, “দর্শকেরা খেলার ফল ছাড়াও একটা বিজ্ঞাপনের জন্য অপেক্ষা করছেন। এই বা কম কী?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy