‘রেইড’ ছবির লুকে অজয় দেবগণ। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
রেইড
পরিচালনা: রাজকুমার গুপ্ত
অভিনয়: অজয় দেবগণ, ইলিয়ানা ডি’ক্রুজ, সৌরভ শুক্ল
ছবিটা দেখতে দেখতে বার বার মনে হচ্ছিল, পরিচালক রাজকুমার গুপ্তই তো একদা ‘আমির’ (২০০৮) এর মতো স্মার্ট আর সেন্সিবল ছবি বানিয়েছিলেন। তারপর তাঁর বানানো ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’ (২০১১), আর ‘ঘনচক্কর’ (২০১৩) ছবি দুটিও দর্শক সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আজ২০১৮-এ এসে হঠাৎ করে ‘রেইড’-এর মতো দুর্বল ছবি বানিয়ে তিনি আমাদের এতটা কষ্ট কেন দিলেন বোঝা গেল না। খামোখা সকাল সকাল গুমোট আবহাওয়াকে আরও কিছুটা গুমোট করে দিলেন। পয়লা চৈত্রের দিনই যেন বসন্তের ইতি ঘটালেন।
ছবিতে আয়কর বিভাগের একজন অফিসার, অময় পট্টনায়ক (অজয় দেবগণ) তাঁর দলবল নিয়ে সকাল সকাল একজনের বাড়িতে আচমকা হানা দেন। অময়ের কাছে গোপন সূত্রে খবর আসে যে এই বাড়িতে ৪২০ কোটি কালো টাকা লুকোনো আছে। কিন্তু এই বিশাল প্রাসাদসম বাড়ির কোথায় সেই টাকা আছে সেটা কেউ জানে না। আদৌ বাড়িতে আছে নাকি অন্য কোথাও আছে সেটা নিয়েও একটা ধোঁয়াশা আছে। বাড়ির মালিক রামেশ্বর সিংহ (সৌরভ শুক্ল) নামক ব্যক্তিটি হলেন উত্তরপ্রদেশ তথা লখনউয়ের প্রবল পরাক্রমশালী একজন বিধায়ক। অবিসংবাদী নেতা। অময় নিজের কাজে খুবই সৎ। নিয়মের পরাকাষ্ঠা। উল্টোদিকে রামেশ্বর অতিব কুটিল। এই বার তার বাড়িতে ২ দিন ধরে এই কালো টাকা খোঁজার বিভিন্ন ঘটনাও টেনশন নিয়ে এই ছবি চলতে থাকে।ছবির প্রচারের সময় একটি কথা বলা হয়েছিল। সেটা হল ইনকাম ট্যাক্স রেইড নিয়ে একটা গোটা ছবি এর আগে হয়নি। হিন্দিতে হয়নি নাকি ভারতে হয়নি নাকি পৃথিবীর কোথাও হয়নি সেই প্রশ্নের উওর অবশ্য দেওয়া হয়নি। কথাটা সত্যি কিনা জানা নেই। কারণ গোটা পৃথিবীর তো প্রশ্নই ওঠে না, নিদেন পক্ষে সমস্ত ভারতীয় এমনকী সমস্ত হিন্দি ছবি যেহেতু আমার দেখা নেই ফলে এই দাবির সত্যতা যাচাই করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যারা দাবি করছেন তারা হয়ত আজ পর্যন্ত তৈরি হওয়া সমস্ত ছবি দেখে তারপর দাবিটি করেছেন। যদিও এরকম দাবি আজকাল অনেকেই করে থাকেন।
ফলে নিজের অজ্ঞানতার কারণে ইনকাম ট্যাক্স রেইড নিয়ে এর আগে যে ছবি হয়নি সে ব্যাপারটা মেনে নিলাম। এখন প্রশ্ন হল কেন হয়নি? ছবিটা দেখতে দেখতেই কারণটা মাথার মধ্যে একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল। কারণ এটা একটা ফিচার ছবি হওয়ার মতো সাবজেক্ট নয়। কথাটা অবশ্য সম্পূর্ণ ঠিক নয়। পৃথিবীতে এর আগে বহু শক্তিশালী পরিচালক অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে ছবি ভাল ছবি বানিয়ে সমালোচকদের বোকা বানিয়েছেন। তারা প্রমাণ করেছেন, যে কোনও বিষয় নিয়েই ভাল ছবি হওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটার জন্য মুন্সিয়ানার প্রয়োজন হয়। রাজকুমার গুপ্তর সেই মুন্সিয়ানা নেই। আর যাঁদের আছে তাঁরা সম্ভবত কোন কারণে এই বিষয় নিয়ে ছবি বানাননি, বানানোর কথা ভাবেননি, নয়ত বানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। ফলে একটা বিষয় ফাঁকা পড়েছিল। কিন্তু এই ছবিটি যতটা না নতুন বিষয়কে এক্সপ্লোর করার কৌতূহলে বানানো হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি করে বানানো হয়েছে খুব সহজে একটা ফাঁকা জায়গা ভরাট করার উদ্দেশ্যে। কেউ বানায়নি বা কম বানানো হয়েছে, ফলে ঢুকে পড়ো। সহজে পাবলিসিটি হয়ে যাবে। বানাতে পারি, কি পারি না সেটা পরের কথা। ছবির নায়ক অজয় একজন সৎ অফিসার। অভিনেতা হিসেবে অজয়ও খুব শক্তিশালী। অজয়ের চেহারায় এক ধরনের কমনম্যান লুক আছে। যা তাঁকে অনেকরকম ম্যানারিজম থেকে মুক্ত করে রেখেছে। খুবই ইন্টারেস্টিং অভিনেতা। কিন্তু ছবি বানানোর উদ্দেশ্য যদি ১০০ শতাংশ সৎ না হয় তাহলে ভাল ছবি কিছুতেই হতে পারে না। নায়কও উদ্ধার করতে পারে না।
‘রেইড’ ছবির একটি দৃশ্যে অজয় ও ইলিয়ানা। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
ছবিতে বিস্তর লজিক্যাল গোলমাল। অনেক কার্যকারণের কোন মধ্যে কোনও যোগাযোগ নেই। ছবি অতিরিক্ত সংলাপ নির্ভর। সবাই সবাইকে চোখা চোখা সংলাপ দিচ্ছে। দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। প্রথম কিছুক্ষণ ভাল লাগে। এই ধরুন আধ ঘণ্টা মতো। তারপর বাকি দেড় ঘণ্টা একই জিনিসের রিপিটেশন। অসম্ভব একঘেয়ে। ছবিতে জোর করে বিভিন্ন চমক আনার চেষ্টা করা হয়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে যুক্তিগুলো ক্রমশ হারিয়ে গিয়েছে। আগেই বলা হয়েছে অজয় খুবই সৎ। নিয়মের বাইরে সে কিছু করে না। কিন্তু হঠাৎ করে সে নিয়ম ভেঙে রামেশ্বরকে রেইড চলাকালীন বাড়ির বাইরে কেন বেরোতে দিল বোঝা গেল না। রেইডের সময় অজয়ের কাছে বাড়ির একটা নকশা ছিল। কিন্তু প্রথমে সেটার কোনও ব্যবহার হল না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে কেউ যখন কিছু পাচ্ছে না তখন হঠাৎ ওঁর মনে হল, আরে একটা নকশা আছে তো! তাহলে এবার এটার সাহায্য নেওয়া যাক। যেটা আরামসে শুরুতেই নেওয়া যেত। কিন্তু না, তাতে চমক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। ছবিটা ১৯৮১ সালের প্রেক্ষাপটে তৈরি। কিন্তু পিরিয়ডের সেট খুবই স্টিরিওটাইপ। প্রপসের তেমন কোনও ইন্টারেস্টিং ব্যবহারও নেই। একমাত্র কল ঘোরানো টেলিফোনের ব্যবহার আছে। তাতেও লজিকের গোলমাল। রেইড চলাকালীন বাড়ির ফোনের কানেকশন কেটে দেওয়া হয়। তারপরেও বাইরে থেকে একের পর এক ফোন কী ভাবে আসতে থাকে কেউ জানে না।
আরও পড়ুন, ইনকাম ট্যাক্সের ‘রেইড’ নিয়ে চিন্তিত কাজল-অজয়?
আরও পড়ুন, মানুষ পাচারের দায়ে দোষী, জেল হল দালের মেহেন্দির
এ সবের জন্য দায়ী ছবির চিত্রনাট্যও সংলাপ লেখক রিতেশ শাহ। তিনি বরাবরই ফাঁকিবাজি স্ক্রিপ্ট লিখে থাকেন। এর আগে ‘পিঙ্ক (২০১৬)’ নামক একটি ডায়লগ সর্বস্বও ভার হাইপ্ড ইন ডোর ড্রামা লিখেছিলেন। এবার ‘রেইড’ লিখে ক্রাইম ড্রামা জনারটার মোটামুটি বারোটা বাজালেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সব রিমেক ছবির গল্পও চিত্রনাট্য লিখে থাকেন। রিমেক ছবির আবার গল্প! যেমন এর আগে তিনি কোরিয়ান ছবি ‘দ্যা ম্যান ফ্রম নো হোয়ার (২০১০)’ এর অফিশিয়াল হিন্দি অ্যাডাপ্টেশন ‘রকি হ্যান্ডসাম (২০১৬)’, হলিউড ছবি ‘শেফ (২০১৪)’-এর অফিশিয়াল হিন্দি অ্যাডাপ্টেশন ‘শেফ (২০১৭)’ এর গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। একটা ছবিও চলেনি। এ ছাড়া তাঁর লেখা বিভিন্ন ছবিতে অনেক বিদেশি ছবির আনঅফিসিয়াল অ্যাডাপ্টেশন দেখতে পাওয়া যায়। ওঁকে লেখক হিসেবে নির্বাচন করাটাই রাজকুমার গুপ্তর কাল হয়েছিল। না হলে ছবির বাকি রসদ তিনি ভালই নিয়েছিলেন। গানে তনিষ্ক বাগচী, অমিত ত্রিবেদী, এডিটর বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়রা ভাল কাজ করে থাকেন। ছবির গোড়াতেই গলদ থাকায় এঁদের কাজ ঠিকঠাক মর্যাদা পেল না। রেইড করার আগে বিস্তর হোমওয়ার্ক করতে হয়। নইলেখালি হাতে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। তখন আর মান সম্মান থাকে না। এরকম রেইড না করাই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy