Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Entertainment News

মুভি রিভিউ: ‘ডুব’ দেখুন আর ডুব দিন প্রেমের সমুদ্রে

গলার কাছে কষ্ট দলা পাকিয়ে আসে। দৃষ্টি ঝাপসা হতে থাকে। পরিচালক যেন হ্যামলিনের রহস্যময় বাঁশিওয়ালা আর সমালোচকের কলম হয়ে যায় সেই বাঁশির সুরে মন্ত্রমুগ্ধ এক শিশু। যার অন্যত্র যাওয়ার কোনও উপায় নেই। মোস্তফা সরয়ার ফারুকি পরিচালিত ‘ডুব’ এ রকমই একটা ছবি। আজকে হয়তো আমার লেখা অনেকটাই আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।

‘ডুব’ ছবির একটি দৃশ্যে ইরফান খান। ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে।

‘ডুব’ ছবির একটি দৃশ্যে ইরফান খান। ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে।

মেঘদূত রুদ্র
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৭ ১৫:১৭
Share: Save:

সিনেমা- ডুব

পরিচালনা- মোস্তফা সরয়ার ফারুকি

অভিনয়- ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রোকেয়া প্রাচী এবং পার্নো মিত্র

আমাদের, অর্থাত্ সমালোচকদের রুটিন মতো দিনের পর দিন ছবির সমালোচনা লিখে যেতে হয়। ছবি ভাল হলে লিখে তৃপ্তি আসে। আর ছবি ভাল না লাগলেও অনেক সময় ডিপ্লোম্যাটিক লেখা লিখে নিজেদের কর্তব্য পালন করতে হয়। লেখা কেউ পড়েন কেউ পড়েন না। এ রকম চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের জীবনে ক্বচিৎ কদাচিৎ এক একটা এ রকম সময় আসে যখন কোনও ছবি দেখে তার সমালোচনা লিখতে বসলে মনে হয় যে এই কাজটার একটা মানে আছে। সে সময় ছবিকে সম্মান জানানোর জন্য উঠে দাঁড়িয়ে রিভিউ লিখতে ইচ্ছে হয়। গলার কাছে কষ্ট দলা পাকিয়ে আসে। দৃষ্টি ঝাপসা হতে থাকে। পরিচালক যেন হ্যামলিনের রহস্যময় বাঁশিওয়ালা আর সমালোচকের কলম হয়ে যায় সেই বাঁশির সুরে মন্ত্রমুগ্ধ এক শিশু। যার অন্যত্র যাওয়ার কোনও উপায় নেই। মোস্তফা সরয়ার ফারুকি পরিচালিত ‘ডুব’ এ রকমই একটা ছবি। আজকে হয়তো আমার লেখা অনেকটাই আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে পাঠকের কাছে এই পক্ষপাতদুষ্ট লেখার জন্য অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আরও পড়ুন, সিভি’তে এত কম ছবি কেন? অফার পান না?

ছবিটি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় তৈরি। ছবিতে এক চিত্র পরিচালকের ভূমিকায় (জাভেদ হাসান) অভিনয় করেছেন ইরফান খান। আর জাভেদের জীবনের ভালবাসার অসহায়ত্ব নিয়ে পরিচালক ক্যামেরার মাধ্যমে বুনেছেন এক নিপুণ কবিতা। সম্পর্কের ছবি তো আমরা অনেক দেখেছি, কিন্তু ছবিকে কবিতা হয়ে উঠতে বিশেষ একটা দেখিনি। মানুষের জীবনে এক একটা সময় আসে, এক একটা মুহূর্ত আসে যা গভীর কালো অন্ধকারময়। কাঁটা বিছানো। অনেকটা অতল সমুদ্রের মতো। সেই সমুদ্রে কখনও ডুবতে হয় কখনও ভাসতে হয়। কখনও পার খুঁজে পাওয়া যায় আবার কখনও যায় না। ছবিটা খুব অনেস্ট ভাবে এই কথাগুলোই বলার চেষ্টা করেছে।

‘ডুব’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে।

সিনেমা সম্পর্কে আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। বাকিদের মধ্যেও ধারণাটা কম-বেশি আছে। কিন্তু আমারা তাদের সবার থেকে এগিয়ে। আমরা অনেকেই মনে করি, ছবিকে দেশ-কাল-সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে। উদ্ধার করতে হবে মানব জাতিকে। অন্য শিল্প মাধ্যমগুলোকে কিন্তু আমরা এই গুরুদায়িত্বটা দিইনি। তাদের বেশ কিছু ছাড় আছে। ফলে তাদের যদি মনের কথা বলার স্বাধীনতা থাকে তা হলে সেই স্বাধীনতা সিনেমারও আছে। সিনেমার কোনও দায় নেই সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার। কোনও দায় নেই শুধুমাত্র জাতির গৌরবময়, আলোকিত মুহূর্তগুলিকে নিয়ে কথা বলে দেশপ্রেমিক হওয়ার। বহু যুগ ধরে বহু পরিচালক এই কথাগুলি বলে এসেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা তাঁদের কোনও কথাই শুনিনি। তাই আজও ফারুকিকে অপমানিত হতে হয় এই শুনে যে ছবিটি কি হুমায়ুন আহমেদের জীবনী? কেন জীবনী? কেন আঁধারঘন জীবনী? কেন জাতির নায়কের শুধুমাত্র গৌরবময় অধ্যায়কে নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়নি? ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশ্চাত্যে পরিচালকদের কিন্তু এই সব বেকার কথা শুনতে হয় না। এটা বঙ্গদেশের বিশেষ চরিত্র।

আরও পড়ুন, সময়ই ছবির মূল্যায়ন করে

ছবিতে যে অসম বয়সের প্রেম, বিবাহবহির্ভূত প্রেম আর তাকে ঘিরে পরিবারের সকল সদস্যের যে অসহায়তা দেখানো হয়েছে তা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটে চলেছে। কোনও নির্দিষ্ট দেশের কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গেই এটা ঘটেছে তেমনটা কিন্তু নয়। ফলে আমার মতে, এটি একটি মৌলিক গল্প, একটি গভীর প্রেমের গল্প। ছবির ট্রিটমেন্টও খুবই শক্তিশালী। তার মধ্যে যেটা সব থেকে চোখে পড়ার মতো সেটা হল একটা ‘থিন মিস্ট অব স্যাডনেস’। বিষণ্ণতার পাতলা একটা কুয়াশা ওড়নার মতো সারাক্ষণ ছবিকে লেপটে রাখে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের খোঁজ যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন যে বিখ্যাত জাপানি পরিচালক ইয়াসুজিরো ওজু, তাইওয়ানের পরিচালক হোউ সিয়ে সিয়ান, সাউথ কোরিয়ান পরিচালক কিম কি ডুকের ছবিতে এই জিনিসটা দেখা যায়। বলছি বটে দেখা যায়, কিন্তু সব চোখ এই ওড়না দেখতে পায় না। ওপারের রহস্য সবার চোখে ধরাও দেয় না। তার জন্য মরমিয়া হতে হয়, শুধু পণ্ডিত হলে হয় না। আর যেহেতু শিল্পের কোনও দেশকাল নেই, নেই কোনও কাঁটাতারের বন্ধন, যেহেতু অনুভূতির কোনও ধর্ম নেই সেহেতু এই ছবিতে কোথায় গিয়ে যেন জাপান, তাইওয়ান, সাউথ কোরিয়া, নীলনদ, পদ্মা, গঙ্গা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ঘুরে দাঁড়ানোর উড়ান ধরলেন দেব

এই স্বল্প পরিসরে ছবির গুণমান ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন কাজ। তার জন্য অনেক পৃষ্ঠা, অনেক সময়, অনেক ব্রেন এক্সারসাইজের দরকার হয়। কিন্তু ছোট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে ছবিতে যাঁরা যাঁরা যে যে ভূমিকায় কাজ করেছেন তা ছবির বিষয়ের সঙ্গে একেবারে সম্পৃক্ত। তা সে তিশা, পার্নো, রোকেয়া প্রাচী, ইরফান-সহ সমস্ত অভিনেতার অভিনয় হোক, তা সে শেখ রাজিবুল ইসলামের ক্যামেরাই হোক, মোমিন বিশ্বাসের এডিট হোক আর রিপন নাথের শব্দ নকশাই হোক। এখানে বাংলাদেশি ব্যান্ড চিরকুটের তৈরি ‘আহারে জীবন’ গানটির কথাও বিশেষ ভাবে করা দরকার। গানটি অপূর্ব এবং ছবিতে এই একটিই গান আছে যেটি বেশ কয়েক বার বিভিন্ন ভাবে ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে। ছবিতে ইরফান খান নিজে বাংলা বলেছেন। সেই বাংলায় একটু হলেও হিন্দি টান আছে। কিন্তু চোখের যে এক্সপ্রেশন, অভিনয়ের যে ইমোশন তিনি দিয়েছেন তাতে মুখের ভাষা অনেকটাই গৌণ হয়ে গেছে। অন্য কেউ শুদ্ধ বাংলায় ডাব করে দিলে এই ইমোশন পাওয়াটা অসম্ভব ছিল। ছবিতে অনেকগুলো ছোট ছোট মুহূর্ত আছে যেগুলো কোনও শব্দ ব্যয় না করে, কোনও সংলাপ না বলে অসংখ্য অনুভূতির কথা বলে দেয়। অনেকগুলি লম্বা লম্বা দৃশ্য আছে যেগুলি একটা অদ্ভুত রহস্য তৈরি করে, একটা কৌতূহল তৈরি করে। এই ভাষা একান্ত ভাবেই সিনেমার ভাষা। অন্য কোনও শিল্প মাধ্যম এটা ক্রিয়েট করতে পারে না।

আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: আদিত্যকে দেখতেই ছবিটা দেখা উচিত

ছবির শুরুর দিকের একটি দৃশ্যে জাভেদ তার মেয়েকে (তিশা) বলেন যে, “আমার বাবার মৃত্যু আমাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে। তা হল মানুষ মারা যায় তখনই যখন প্রিয়জনের সঙ্গে তার যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়।” আর ছবির শেষে জাভেদের মৃত্যুর পর আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে এই একই কারণে তারও মৃত্যু ঘটেছে। অসুখবিসুখ তো একটা অছিলা মাত্র। এই যোগাযোগহীনতাই বর্তমান সভ্যতার সবথেকে বড় সঙ্কট। আর এর থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র প্রেমই। তবে শোনা যায় এখনকার ব্যস্ত, স্মার্ট, আধুনিক পৃথিবীতে নাকি প্রেমের মানে পালটে গেছে। এখন নাকি আর বোকার মতো প্রেমে পড়তে নেই, অসহায়ের মতো প্রেমের জ্বালা সহ্য করতে নেই। অনেক স্ট্র্যাটেজি, ইকুয়েশন, ক্যালকুলেশন, অনেক যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ ইত্যাদি করে নাকি প্রেম করতে হয়। তাতে নাকি বোকা বনে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচা যায়, দুঃখও নাকি কম পাওয়া যায়। তবুও এই স্ট্র্যাটেজিকাল পৃথিবীতে আমাদের মধ্যে বেঁচে ছিলেন এক জন লিওনার্দ কোহেন, আজও বেঁচে আছেন এক জন কবীর সুমন, এক জন শাহরুখ খান, এক জন মোস্তফা সরয়ার ফারুকি। যাঁরা তাঁদের জীবন, তাঁদের যাপন, তাঁদের কর্মের মাধ্যমে আজও পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ভালবাসা বোধকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এঁদের লালন করতে হয়, এঁদের পালন করতে হয়, এঁদের আদর করতে হয়। নইলে এক দিন সকালে যদি তাঁরা এই ক্যালকুলেটিভ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে হঠাৎ নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেন, সেই দিন চিনের প্রাচীরের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা কুটে মরলেও আমাদের মধ্যে আর প্রেম ফিরে আসবে না।

তাই আসুন, ‘ডুব’ দেখুন আর ডুব দিন প্রেমের অতল সমুদ্রে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE