‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
প্যারডিটা ছবিতেই আছে। তুতুতু তু তু তারা/যা রহা হ্যায় টাইগার অন মিশন দোবারা।
তা সেই অভিযান নীনা জোসেফ, সান্দ্রা সেবাস্তিয়ান, মওরিনরা দেখতে যেতেই পারেন। তবে তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে পর্দার কাহিনির মিল খুঁজে পাবেন না।
ওঁরা কেরলের কোট্টায়াম জেলার তরুণী, পেশায় নার্স। একদা কাজ নিয়ে পাড়ি দেন ইরাকের টিকরিট হাসপাতালে। মোট ৪৬ জন ছিলেন। এক জন বাদে বাকি সবাই কেরলের। ২০১৪-র ৩ জুলাইতাঁরাইসলামিক স্টেট বা আইএস জঙ্গিদের খপ্পরে পড়েন। এক রাত তাঁদের মসুলে জঙ্গি ডেরায় কাটাতে হয়। পর দিন জঙ্গিরা নার্সদের পাঠায় ইরাকি কুর্দিস্তানের আরবিল বিমানবন্দরে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমান তাঁদের নিয়ে কোচিতে নামে ৫ জুলাই।
নাম ভূমিকায় সলমন খানকে রেখে যশ রাজ ফিল্মস-এর দেড়শো কোটি টাকারও বেশি বাজেটের ছবি ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’-এর কাহিনির ভিত্তি ওই ঘটনা। কিন্তু ভারতীয় নার্সদের সবাই নির্ঝঞ্ঝাটে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশে ফিরলে দেশের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ বা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর সব চেয়ে দক্ষ এজেন্ট অবিনাশ সিংহ রাঠৌর ওরফে টাইগার কী ভূমিকা নেবেন? আর শুধু টাইগার নন, রাখতে হবে তাঁর স্ত্রী,পুত্র জুনিয়রের মা জোয়া বা ক্যাটরিনা কইফকে। যিনি আবার পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের এজেন্ট।
অতএব,‘টাইগার’ সিরিজের দ্বিতীয় ছবিতে টিকরিট নয়, ‘ইকরিট’ হাসপাতালের নার্সদের পদে পদে বিপদ আইএস নয়, ‘আইএসসি’ জঙ্গিদের থেকে। সাত দিন ধরে পণবন্দি থাকা নার্সদের সংখ্যা এখানে ৪০। তবে ভারতীয় ২৫ জন। বাকি ১৫ জন পাকিস্তানের। তাঁরা এক মেস-এ থাকেন, এক সঙ্গে খুনসুটি করেন। ‘দুনিয়ার সব চেয়ে খতরনক’ জঙ্গি সংগঠনের কবল থেকে ওই নার্সদের উদ্ধার করতে তাই‘র’ এজেন্ট স্বামী এবংআইএসআই এজেন্ট স্ত্রী তাঁদের নিজস্ব দল নিয়ে একসঙ্গে অভিযানে নামেন। এমন এক জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে, যা বাস্তবেও দু’দেশের কাছে বিপদ।
বলিউড-টলিউড-টেলিউডের হিট খবর জানতে চান? সাপ্তাহিক বিনোদন সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
গত রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের কোয়েটায় আইএস হামলায় নিহত হয়েছেন আট জন, জখম ৫০। আর ভারতে গত ৭ মার্চ মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে আইএস জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটায়, যাতে জখম হন ১০ জন।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: যৌন ঈর্ষা আর একাকী বারান্দার আখ্যান
কিন্তু র, আইএসআইয়ের মতো চিরশত্রু হাতে হাত মিলিয়ে সশস্ত্র অভিযানে সামিল, এমনটা বাস্তবে তো দূর, আগে বলিউডের কোনও ছবিতে দেখা যায়নি। এটাই ছবির ইউএসপি,বাস্তবের চেয়ে অ-নে-ক অ-নে-ক বড় দেখানো সলমন বা টাইগারকে বাদ দিলে।
‘টাইগার’-এর সঙ্গে নেকড়ের লড়াই। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
ইরাকে যে বছরের ঘটনাপ্রবাহের উপর পরতে পরতে মশলা মাখিয়ে জারিয়ে রেখে পাক দিয়ে এই ছবি তৈরি, সেই ২০১৪-র অগস্টেআইএস জঙ্গিরা সিরিয়ার রাকায় গলা কেটে খুন করে মার্কিন সাংবাদিক জেমল ফুলি-কে। তার ভিডিও টেপ-ও প্রকাশ করেছিল আইএস জঙ্গিরা। মূলত তার পরেই আমেরিকাআইএসের বিরুদ্ধে ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হানা শুরু করে।
ছবির শুরুতে মার্কিন সাংবাদিক জেমস-এর হত্যাকাণ্ড। এর পর মসুল জয় করা আইএসসি যোদ্ধারা ঢুকল ইকরিটে। কিন্তু তখনই হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া ইরাকি সেনার গুলিতে গুরুতর জখম হলেন জঙ্গিদের এক নম্বর নেতা আবু উসমান। চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইকরিট হাসপাতালে। যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের ৪০ জন নার্স কর্মরত। এক নার্স গোপনে মোবাইল থেকে ফোন করে সব জানান বাগদাদে ভারতীয় রাষ্টদূতকে (বাস্তবেও টিকরিট থেকে ভারতীয় নার্সরা রাষ্ট্রদূত অজয় কুমারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখতেন)।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: কাতুকুতু দিয়ে হাসাল ‘ফুকরে রিটার্নস’
একে সাংবাদিক জেমস নিহত, তার উপর আবু উসমান ভর্তিআছে জেনে আমেরিকা ইকরিট হাসপাতালে বিমানহানা চালাতে চাইছে। কিন্তু অষ্টপ্রহর নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো, র-এর প্রধান শেনয় বা গিরীশ করনাড নার্সদের বার করে আনার জন্য সময় চাইলেন। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থাসিআইএ চিফ অ্যাডাম সাত দিন সময় দিলেন এবং জানালেন, অষ্টম দিনে আমেরিকা বিমান হানা চালাবে।তখনখোঁজ শুরু হল টাইগারের।
এই সিরিজের প্রথম ছবি ‘এক থা টাইগার’-এ জোয়ার প্রেমে পড়ে চরবৃত্তি বিসর্জন দিয়ে ঘর বাঁধেন টাইগার। সরকারি ফাইল বলছে, কিউবায় টাইগারের মৃত্যু হয়েছে। আট বছর পর প্রায় অসম্ভব এক মিশনে নেমে সেই টাইগার যে সফল হবেন, তা তো জানা কথা। কিন্তু কী ভাবে? ছবি সেটাই বলবে।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: এ বার থেকে ফিল্মেও আপনাকে দেখার অপেক্ষায় থাকব কপিল
এই ছবি অবশ্যই সলমনের। এক দিকে একা তিনি, অন্য দিকে বাকি সবাই। অস্ট্রিয়ায় আল্পস পাহাড়ের বরফ ঢাকা জঙ্গলে হিংস্র নেকড়ের পালকে তিনি খালি হাতে ঠেকাতে পারেন, আবু ধাবির মরুভূমিতে অভিযানের পরিকল্পনা করেন, ইকরিট শহরের সরু রাস্তায় ঘোড়া ছুটিয়ে চড়ে জঙ্গিদের রকেট লঞ্চার হানা ব্যর্থ করে দেন। অ্যাকশনের সময়ে এই সলমন যেন একাধারে সিলভেস্টার স্ট্যালোন ও আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার। ২৫ কেজি ওজনের এম ফর্টি টু মেশিনগান হাতে উঠিয়ে চালান তিনি।একই সঙ্গে তিনি সংবেদনশীল প্রেমিক, দায়িত্ববান পিতা। দাবাঙ্গ, বজরঙ্গি ভাইজান, টিউবলাইট বা অন্য কোনও ছবিতে কি সলমন একা এতটা পর্দা জুড়ে ছিলেন? মনে হয় না।
‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
পরিচালক আলি আব্বাস জাফর দেড় বছর আগে যশ রাজের ব্যানারে আনেন ‘সুলতান’। সলমন যেখানে মধ্যবয়স্ক কুস্তিগীর। কিন্তু স্পোর্টস ড্রামা আর অ্যাকশনধর্মী স্পাই থ্রিলার ছবি তো এক নয়। আরব দুনিয়া ও ইওরোপে শ্যুটিং সমৃদ্ধ এই ছবিসিনেমাটোগ্রাফি, স্পেশ্যাল এফেক্টস-এ বহু হলিউডি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, তবু থ্রিলারে যা অপরিহার্য, সেই মোচড় নেই, ঘটনার আকস্মিকতা নেই। নীরজ পাণ্ডের ‘বেবি’-র সঙ্গে এখানেই এর পার্থক্য।
এমন ধামাকাদার ছবিতে কেউ দুর্ধর্ষঅভিনয় করবেন, সেইআশা করা উচিত নয়। তা-ও অঞ্জলি গুপ্ত, কুমুদ মিশ্র, সিদ্ধার্থ বসুর অভিনয় নজরে পড়েছে। কিন্তু তুখোড় অভিনেতাপরেশ রাওয়ালের মুখ দিয়েবাংলাদেশের নাগরিকের উদ্দেশে ‘ভাত খেয়ে দিনে ঘুমোলে খারাপ হবে’-র মতো অপমানকর কথা বলানোর কিদরকার ছিল? তবে ফিরদৌসের ভূমিকায় পরেশ ‘র’ এবং আইএসআইয়ের এক সঙ্গে এক মিশনে কাজ করার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘পিএম সাব কো পতা হ্যায়?’ এটা অসাধারণ। আতিফ আসলামের গাওয়া ‘দিল দিয়াঁ’ ভাল লেগেছে।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: এত তাল কাটাকাটি নিয়েও ‘সমান্তরাল’!
একটা খচখচানি অবশ্য থাকছে। ছবিটা পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছে। ১৫ পাকিস্তানি নার্সের পণবন্দি হওয়ার ঘটনা ‘র’ প্রথমে চেপে গিয়েছিল।আইএসআই এজেন্টেরস্বামী হওয়ার কারণে টাইগারকে ‘র’ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না। ছবিতে এ সব থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সেন্সরস কেননিষিদ্ধ করল, তা বোধগম্য হল না। আইএস যে বহু তরুণীকেযৌন ক্রীতদাসী হিসেবে ব্যবহার করে, আমেরিকা যে আরব দুনিয়ায় তেলের দখলদারি পেতে মরিয়া এবং নিজের স্বার্থ ছাড়া যুদ্ধ করে না,সে সবও বলা হয়েছে সূক্ষ্ম ভাবে।
তবে আইএসআইয়ের অফিসার ভারতের জাতীয় পতাকা ওড়ালেন, এমন দৃশ্য কবে কোন ভারতীয় থ্রিলার ছবিতে দেখা গিয়েছে? এবং এই দৃশ্যে হাততালিতে ফেটে পড়েছে মাল্টিপ্লেক্স। দু’দেশের যুদ্ধবাজ রাজনীতিবিদরা এটা কি মাথায় রাখবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy