Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

এই শহরে গরিব ও বড়লোকের কোনও পার্থক্য নেই

তিলোত্তমা কলকাতা, কল্লোলিনী কলকাতা, সুন্দরী কলকাতা। ‘আমার শহর’ ‘আমার’ কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ-এ নিয়ে তো সন্দেহ নেই। তখন স্কুলে পড়ি। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে স্কুল থেকে প্যারেড প্র্যাক্টিসের জন্য ভোরবেলা রেড রোডে পৌঁছতে হবে।

নূপুরছন্দা ঘোষ (সঙ্গীতশিল্পী)
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ১৪:৫৮
Share: Save:

তিলোত্তমা কলকাতা, কল্লোলিনী কলকাতা, সুন্দরী কলকাতা। ‘আমার শহর’ ‘আমার’ কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ-এ নিয়ে তো সন্দেহ নেই। তখন স্কুলে পড়ি। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে স্কুল থেকে প্যারেড প্র্যাক্টিসের জন্য ভোরবেলা রেড রোডে পৌঁছতে হবে। কী আনন্দ, কী উত্তেজনা। রাস্তার বাতিগুলো সবে নিভে ভোরের আলো একটু একটু ফুটছে, ট্রাম চলা শুরু হচ্ছে গঙ্গাকল রাস্তার ধারে। সেই জলে রাস্তা ধোয়া হচ্ছে, ঠুনঠুন ঘণ্টা বাজিয়ে রিকশা চলা শুরু হচ্ছে, সঙ্গে একটা ঠেলা গাড়ি। সেই ভোরের ছবিটা এখনও চোখে ভাসে। বেলা বাড়ে। সকাল ৯টা বাজতেই সাইরেন। দেখেছি অনেকেই ঘড়ি মিলিয়ে নিতেন। তখন বড় বড় মোড় গুলোতেই ট্র্যাফিক লাইট থাকত।

দুপুরে গরমের ছুটিতে ঝাঁ ঝাঁ রোদ ও হিংসুরমা চাই বলে কাবুলিওলাদের ডাক যেন এখনও কানে ভাসে। আবার তীক্ষ্ণ গলায় ‘বাসন চাই বাসন’ বলে মহিলা গলার সাড়া পাওয়া যেত বাড়ির তিনতলার ছাদ অবধি। যেখানে রোদে শুকোত কাঁচা আমের আচার, বড়ি। সন্ধের মুখে বেল ফুল হেঁকে ঝুড়ি মাথায় নিয়ে পাড়া সুগন্ধময় করে তুলত। আবার কেউ আনত ঘুগনি আলুর দম, কুলপি আইসক্রিম।

মাঝে মধ্যেই এই শহরের ব্যামো হয়। ট্যাক্সি বলে ডাকলে, তারা বেশির ভাগ সময়েই ‘যাব না’ বলে দেয় মুখের ওপর। এটাই যেন রীতি। তবে হালফিলের ‘উবের’ ‘ওলা’র দৌলতে আমার শহরে ট্যাক্সির সমস্যাটা অনেকটা কমেছে।

ছোটবেলায় দেখেছি দোলের আগে পাড়ায় পাড়ায় খঞ্জনি বাজিয়ে বেশ জমিয়ে গান ধরত অনেকেই। ঝাঁপঝাপ্পা করতে করতে কোন সপ্তকে চলে যেত, ভারি মজা লাগত শুনতে। বসন্ত কি এখনও আসে আমার শহরে? সেই আগের মতো? নিজেকেই প্রশ্ন করি। হঠাৎ শুনি কোকিল ডেকে উঠল এই শহর কলকাতায়। তখন দিব্যি বোঝা যায় ‘মধুকালে এল হোলি’। পরিস্থিতির বদল তো হবেই। আগের মতো হোলি না হলেও প্রকৃতির বসন্ত ঋতুরাজ জানান দেয়, ফুলের সমারোহে আমার ছাদ ভরে ওঠে। বেল, জুঁই, চামেলি, রকমারি জবা।

বসন্ত যেতে না যেতেই চৈত্রের সেলের ডাক এখনও জানান দেয় গড়িয়াহাট, হাতিবাগান বাজারে। আজকাল ছেলেমেয়েরা এই সেল-এর প্রলোভনে ভোলে না। কত নতুন ‘শপিং মল’ দেখলে গর্ব হয়। ২০০১ সালে যখন আমেরিকা গেছি তখন ওদের মল দেখে অবাক হয়েছি। কিন্তু এই ১৫ বছরেই আমার শহরের কত উঁচু মল বিদেশের থেকে কোনও অংশে কম নয়। আমার শহরের এটাই বিশেষত্ব গরিব ও বড়লোক পাশাপাশি চলছে কেউ বা ফুটপাতে কেনাকাটা করছে। কেউ বা বিশাল মল-এ ভিড় জমাচ্ছে।

আগে সিনেমা দেখতে গেলে ১২, ৩, ৬, ৯টা এই মোটামুটি শো টাইম ছিল। কিন্তু এখন মলগুলোতে ‘মাল্টিপ্লেক্স’-এর দৌলতে শহরের যে কোনও সময়ে যে কোনও সিনেমা দেখা যেতে পারা যায়।

সিনেমা যাওয়ার সঙ্গে খেতে যাওয়া একটা ব্যাপার ছিল। আগে খেতে হলে আমরা জানতাম পার্কস্ট্রিট। কিন্তু এখন উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম শহরের কোনও দিকটাই বাকি নেই যেখানে ছোট থেকে শুরু করে বড় রেস্তোরাঁয় শুধু ইউরোপিয়ান, চাইনিজই নয়, লেবানিজ, থাই, ইটালিয়ান সবই আছে। কিন্তু যখন দেখি বাঙালি রোস্তোরাঁয় লাইন দিয়ে সবাই অপেক্ষায় আছেন কখন ভেতরে গিয়ে বাঙালি খাবার খাবেন, তখনই আমার বড় দুঃখ হয়। কেন জানেন? এদের মা, কাকিমা, পিসিমা কেউ কি নেই যারা রেঁধে খাওয়াবেন ডাল পোস্ত, মোচারঘণ্ট, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, পটলের দোর্মা বা ইলিশের ভাপা? আমরা কি ভুলে গেলাম এই সব রান্না?

নববর্ষে হালখাতা উপলক্ষে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর মায়ের মন্দিরে মানুষ যেন উপচে পড়ে মিষ্টির প্যাকেট ও ক্যালেন্ডার নিয়ে। দেখলে বড় ভাল লাগে, মনে হয় আমার শহর তো ঠিক তেমনটাই আছে যেমনটা ছিল আমাদের ছোটবেলায়। বেশ মনে আছে বাবার এক বন্ধুর দোকান ছিল, নববর্ষ দিন সেই কাকুর দোকানে নতুন জামা পরে যেতাম। কত লোক। কী যে আনন্দ।

ছোটবেলায় বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটাও ছিল খুব রঙিন। সে দিন সোজা উত্তরে বড়পিসিবাড়ির ছাদে যেন উৎসব বসত। সব পিসতুতো ভাইরা, বোনেরা একই ছাদ থেকে ঘুড়ির লড়াইয়ে মেতে উঠত। একটা ঘুড়ি কাটছে অমনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার ‘ভোঁ কাট্টা’। কেউ ঘুড়ি বাড়ালেই চিৎকার উঠত ‘দুয়ো বাড়ে নাক্কো’। উত্তর কলকাতা জিতে যেত সব সময় দক্ষিণ কলকাতার কাছে। উত্তরের মতো এত ঘুড়ি উড়তে আমি কোনও দিন দেখিনি দক্ষিণের আকাশে।

কলকাতা ছেড়ে কোথাও গেলে বুকের ভেতরটা কেমন ভয় ভয় করত। কয়লার ইঞ্জিন ভস করে কেমন একটা আওয়াজ করত। স্টেশন থেকে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোলেই বুকের মধ্যে কেমন খালি লাগত। মনে হত আবার কবে ফিরব?

প্রবাসী বাঙালিদের বলতে শুনি ‘কী আছে তোমাদের কলকাতায় যে যাব?’ ওদের বলি আমাদের আছে ‘মা পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে’, আছে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। হাওড়া ব্রিজ, দ্বিতীয় হুগলি সেতু। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ি, মায়ের বাড়ি। ভাবা যায় যখন ‘আমার শহর’ দুর্গোৎসবে আলোকিত হয়ে ওঠে তখন দূরদুরান্ত থেকে মানুষ আসে এই আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে। তেমনটা কি আর কোনও শহরে হয়। এখনও পাড়ার মানুষ এই সময়টিতে এক হয়ে যায় সব ভুলে এই মিলন উৎসবে। ভিড়ের ঠেলায় প্রাণ যায় যায় হলেও মনে শুধুই আনন্দ আর খুশি। পাঁচ দিন পরে বিসর্জনের দিন এখনও সেই রাস্তার ধারে মানুষের ভিড়, রাস্তায় লাইন দিয়ে লরিতে প্রতিমা সঙ্গে আলোর রোশনাই। জাঁকজমক কিছুটা পাল্টেছে। এখন তো মেয়েরাও কেমন নাচতে নাচতে বিসর্জনে যায়।

আস্তে আস্তে যখন রাত বাড়তে থাকে বাজনা আর বাজির বহর কমতে থাকে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। তবে কলকাতায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। দুর্গাপুজো শেষ হতে না হতেই কালীপুজো। সেখানেও আলোর রোশনাই, বাজির চমক। কালীপুজো শেষ। তারপর ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, বোনেরা ভাইদের মঙ্গলকামনায় ফোঁটা দিচ্ছে। বাড়ি বাড়ি শঙ্খধ্বনি, মিষ্টির দোকানে ভিড়, চন্দন ঘষতে ঘষতে মনে মনে গেয়ে উঠি—

ভায়ের মায়ের এত স্নেহ

কোথায় গেলে পাবে কেহ

ওমা তোমার চরণ দুটি

বক্ষে আমার ধরি

আমার এই দেশেই জন্ম

যেন এই দেশেতেই মরি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nupurchhanda Ghosh singer Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE