১৯৮৭। একটি ফটোশুটে সুপ্রিয়া দেবী।— ফাইল চিত্র।
সুপ্রিয়া চৌধুরীর দেহাবসানে আবার প্রমাণিত হল যে অভিনয় একটি শিল্প এবং তাতে শুধু প্রতিভা নয়, শ্রম ও অধ্যবসায় সমান কার্যকরী। কী পরিশ্রমী না বর্মা ফেরত পাবনা জেলার এই তরুণী। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় নিজেকে কথ্য ঢাকাই বাংলার সঙ্গে অভ্যস্ত করে ফেলেন আর একইসঙ্গে একেবারে ঘটি গীতা দে-কে প্রশিক্ষিত করেন পূর্ববঙ্গীয় কথ্যরীতিতে। যদি ১৯৫৯ সালের ‘আম্রপালী’ ছবিটির দিকে তাকাই তা হলে খেয়াল করতে হয় সুপ্রিয়ার নৃত্যসুষমা সমগ্র দেহকে কী ভাবে বিচ্ছুরিত করেছে। আর ঋত্বিক ঘটকের বিখ্যাত দু’টি ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও ‘কোমলগান্ধার’-এর কথা তো এখন কিংবদন্তির মতো।
দুঃখের কথা, আরও অনেকের মতোই সুপ্রিয়া চৌধুরী তাঁর জীবদ্দশায় যথার্থ মূল্য পেলেন না। নানা গুজবে পল্লবিত হয়ে মহানায়কের সঙ্গিনী হিসেবে তাঁকে সিনেমার পর্দা থেকে সিরিয়ালের নানা স্তরে বর্ণনা করা হল। কিন্তু খেয়াল করা হল না যে স্বাধীনতার পরবর্তী কালে বাংলা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে সুপ্রিয়া চৌধুরীর কিছু অবিস্মরণীয় দিকচিহ্ন ছড়ানো আছে। এটা তাঁর দুর্ভাগ্য, ঋত্বিক ঘটক ছাড়া আর কোনও বড় মাপের চলচ্চিত্রকার তাঁকে ব্যবহার করতে উৎসাহ পাননি। কিন্তু যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন তখনই টালিগঞ্জের কাদাজলেও পঙ্কজ হয়েই ফুটে উঠেছেন। এ তো প্রায় অবিশ্বাস্য সমাপতন যে ১৯৫২ সালে ভারতবর্ষ প্রথম প্রজাতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করছে ভোটাধিকারের মাধ্যমে। আর একইসঙ্গে নির্মল দে-র ‘বসু পরিবার’ ছবিতে স্বাক্ষরিত অভিনয় করে যাচ্ছেন উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও সুপ্রিয়া দেবী। বস্তুত, জনপ্রিয় সিনেমার স্তরে স্তরে ইতিহাস যে লুকিয়ে কথা বলে, এ কথা সুপ্রিয়া নানা সময়ে প্রমাণ করেছেন। যেমন বলা যায়, অসিত সেনের পরিচালনায় ১৯৬১ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে করা তাঁর ‘স্বরলিপি’ ছবি। পোশাকে-আশাকে, সংলাপে ও সামাজিক সমস্যার রূপায়ণে সুচিত্রা ও কানন দেবীর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রায় কী করে নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনযাপন চিত্রিত করতে হয় সুপ্রিয়া তা দেখাতে পেরেছিলেন। একই সময়ে উত্তমকুমারের সঙ্গে করা তাঁর ‘শুন বরনারী’ অজয় করের হাতের ছোঁয়ায় একটি সম্পূর্ণ গীতিকবিতা হয়ে ওঠে। এমনকী, সত্তর দশকে যখন তিনি উত্তমকুমার পরিচালিত ‘বনপলাশির পদাবলী’-তে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন তখন তাঁকে উত্তম-নিরপেক্ষ ভাবেই স্মরণীয়া মনে হয় আমাদের। ষাটের দশকের একেবারে শুরুতে ‘মন নিয়ে’ নামের একটি তুচ্ছ ছবিতে তাঁকে যে মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দেখেছিলাম, আজকের বাংলা ছবিতে তার কোনও তুলনা টানার চেষ্টা করে লাভ নেই।
‘ইমন কল্যাণ’ ছবিতে উত্তম-সুপ্রিয়া।— ফাইল চিত্র।
আসলে সুপ্রিয়া আমাদের রোম্যান্টিক নায়িকাদের মধ্যে সত্যিই অন্য গোত্রের। তাঁর কণ্ঠস্বর অত কমনীয় নয়, শরীরের দিক থেকে, অর্থাৎ যৌন ব্যঞ্জনায় তিনি আক্রমণাত্মক ও চলাচলের মধ্যে সংস্কৃত কাব্যের কমনীয়তা তিনি সচেতন ভাবেই পরিহার করেছেন। ফলে ফ্রয়েডের কাছে ঈষৎ ঋণ স্বীকার করেই বলা যায়, পর্দা জুড়ে সুপ্রিয়া চৌধুরীর উপস্থিতি একই সঙ্গে চোখের আহ্লাদ, কিন্তু বিপজ্জনকও বটে।
আরও পড়ুন, ‘রান্না নয়, সংসার করতে শিখিয়েছিলেন বেণুদি’
ঋত্বিক ঘটক সুপ্রিয়া চৌধুরীর এই রহস্য ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে সনতের পক্ষে নিতা যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা লো অ্যাঙ্গল ক্যামেরায় সুপ্রিয়ার সর্বাঙ্গীন রূপায়ণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। আর একটি বিষয় নজর করার মতো, তা সুপ্রিয়ার দীর্ঘ গ্রীবা। এই গ্রীবা অনেক সময়েই তাঁকে গ্রেট মাদার ইমেজের ধারেকাছে নিয়ে যায় ‘কোমলগান্ধার’-এ। উদ্বাস্তু কলোনির একটি মেয়ে কী ভাবে বিশ্বজননী হয়ে উঠতে পারে তা নিশ্চয়ই ঋত্বিক ঘটকের জানা ছিল। তবু তাতে সুপ্রিয়ার অবদান অস্বীকার করা যায় না। উত্তমকুমারের সঙ্গে তিনি যে সমস্ত ছবি করেছিলেন তাতে বাংলা নায়িকার চিরকালীন শ্রীরাধা গোত্রের ছাঁচটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা ছিল। ব্যক্তিগত জীবনের নানা অনিয়মের মধ্য দিয়েও সুপ্রিয়া আমাদের কাছে এক জন স্টার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। বিবাহিত জীবনে তাঁর অশান্তি বা উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, সবটার দিকে তাকালেই আজ মনে হয়, হলিউড সম্রাজ্ঞী লিজ টেলরের সঙ্গে তাঁর কিছু মিল আছে। তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের আঙিনায় সেই গরলাঙ্গুরীয় নারী যিনি উত্তমকুমারকে ছিনিয়ে নিয়ে পারেন। যিনি উদ্বাস্তু জীবনের অন্ধকারে রক্তবমি করতে পারেন। আবার আরতি মুখোপাধ্যায়ের গলায় অদ্ভুত লাবণ্য ছড়িয়ে গেয়ে উঠতে পারেন, ‘এক বৈশাখে দেখা হল দু’জনায়/জৈষ্ঠ্যতে হল পরিচয়...।
আরও পড়ুন, ‘দীর্ঘ দিনের বন্ধুকে হারালাম’
বাংলা ছবির ইতিহাস তাঁর এই পরিচয়পত্র সযত্নে সংরক্ষিত রাখবে।
(লেখক চলচ্চিত্র গবেষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy