Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
Satyajit Ray

স্মৃতির মানিক আজও উজ্জ্বল

তিনি চলচ্চিত্রের মানুষ নন। অথচ তাঁরই সংগ্রহে রয়েছে সিনেমার পোস্টারের এক বিরল সংগ্রহ। তাঁর সংগ্রহের প্রাচীন মুদ্রা, মূর্তি, পট কিংবা ছবির সংগ্রহ নানা ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন ছবিতে। সেই সূত্রে গড়ে উঠেছিল সত্যজিতের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক। স্মৃতি হাতড়ালেন পরিমল রায়। শুনলেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যতিনি চলচ্চিত্রের মানুষ নন। অথচ তাঁরই সংগ্রহে রয়েছে সিনেমার পোস্টারের এক বিরল সংগ্রহ। তাঁর সংগ্রহের প্রাচীন মুদ্রা, মূর্তি, পট কিংবা ছবির সংগ্রহ নানা ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন ছবিতে। সেই সূত্রে গড়ে উঠেছিল সত্যজিতের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক। স্মৃতি হাতড়ালেন পরিমল রায়। শুনলেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৬ ০০:৫২
Share: Save:

সালটা ১৯৫৯। তখন আমাদের পাড়ায় ‘কথা বিচিত্রা’ নামে একটা হাতে লেখা পত্রিকা ছিল। পাড়াতেই চিত্রশিল্পী নীরদ মজুমদারের যাতায়াত থাকায় তাঁর সঙ্গে ভালই যোগাযোগ ছিল। সেই পত্রিকার ছবির সূত্রেই এক দিন নীরদদার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন মানিকদা থাকতেন লেক অ্যাভিনিউতে।

প্রথম সাক্ষাতেই বেশ অবাক হয়েছিলাম। ছ’ফুট উচ্চতা, গম্ভীর কণ্ঠস্বর, আর অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব। নীরদদার সঙ্গে পূর্ব পরিচয় থাকায় নানা বিষয়ে গল্প চলতে থাকল। তার মধ্যে আমি যেন ‘হংস মধ্যে বক যথা’ হয়ে বসে রইলাম। যাই হোক, অবশেষে আমাদের পত্রিকার বিষয়ে কথা ওঠায় মানিকদা সানন্দে বললেন তিনিও ছবি এঁকে দেবেন। সে দিনের কিছু কথা আজও মনে পড়ে। কথা প্রসঙ্গে মানিকদার নতুন ছবির কথা উঠল। তখন ‘অভিযান’-এর পরিকল্পনা চলছিল। মানিকদা বললেন, ‘‘নায়িকা ঠিক করতে পারছি না।’’ শুনে নীরদদা হঠাৎই বলে বসলেন, ‘‘ভারতবর্ষে নায়িকা তো এক জনই, ওয়াহিদা রহমান।’’ ঠিক তেমনটাই অবশ্য হয়েছিল। আমি ‌তখনও চাকরিতে ঢুকিনি তাই হাতে সময়ের অভাব ছিল না। আমি চলচ্চিত্রের লোক নই। পুরনো ফেলে দেওয়া নানা জিনিসপত্র সংগ্রহ করছি দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে। তার মধ্যে প্রাচীন মুদ্রা, মূর্তি, ছবি, পট, সিনেমার পোস্টার, ঝাড়বাতি উল্লেখ্য। এ সব পুরনো জিনিসকে নিয়েই মানিকদার সঙ্গে আমার একটা অদ্ভুত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই কারণেই মানিকদার বহু ছবিতে আমার সংগ্রহের খুঁটিনাটি অনেক জিনিসই ব্যবহৃত হয়েছে। সেটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

তার পরে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় বেশ কিছু দিন যোগাযোগ ছিল না। আমরা বন্ধুরা আড্ডা দিতাম ভবানীপুরের ‘ইমেজ’ স্টুডিওতে। আসতেন বসন্ত চৌধুরী, নিমাই ঘোষ অনেকেই। এক বার ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ এস্টেট থেকে ফিরে এক দিন আড্ডায় জায়গাটির বর্ণনা দিচ্ছি, সেটা শুনে নিমাই ঘোষ মানিকদাকে জায়গাটির কথা বলেন। আসলে সেই সময়ে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছিল। ঠিক তার পরের দিন সকালে আমি মানিকদার ফোন পেলাম। দেখা করার পরে আমরা কয়েক জন মিলে ময়ূরভঞ্জ এস্টেটে গিয়েছিলাম লোকেশন দেখার জন্য। সেখানেই অবশ্য শ্যুটিং হয়েছিল। সেই যে আবার নতুন করে যোগাযোগ হল সেটা আজ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন রয়েছে রায় পরিবারের সঙ্গে।

এর পরে মানিকদা যখন ‘ফটিকচাঁদ’ ছবি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন, এক দিন ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন ষষ্ঠ জর্জ-এর কিছু নোট ও মুদ্রার প্রয়োজন। আমি সেগুলি বড়বাজার থেকে জোগাড় করে দিয়েছিলাম। যত দূর মনে পড়ছে পূর্ণ সিনেমা হলে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি দেখার পরে বেশ অবাক হয়েছিলাম। ছবিতে দৃশ্যটা ছিল, আগ্রা কেল্লার নীচে এক জন খেলা দেখাচ্ছেন, আর উপর থেকে বহু মানুষ টাকা পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তার জন্য ষষ্ঠ জর্জ-এরই নোট কিংবা মুদ্রার প্রয়োজন কেন? পরে অবশ্য অনুধাবন করেছিলাম মনিকদা কতটা ‘perfectionist’ ছিলেন।

‘ঘরে বাইরে’ ছবির কাজ চলাকালীন মানিকদা এক দিন ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘পরিমল, সোনার মোহর পাওয়া যাবে?’’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী ধরনের মোহর? আকবরি না ভিক্টোরিয়ান? মানিকদা বললেন, ‘‘ভিক্টোরিয়ান।’’ আসলে, ভিক্টোরিয়ান মোহর দু’রকম— একটি পয়সা-মোহর, অন্যটি খেজুরছৌড়ী মোহর। আবার এই পয়সা-মোহর আর তামার ভিক্টোরিয়ান এক পয়সা দেখতে হুবহু একই রকম। এর পরে বেশ কিছু মোহর নিয়ে তাঁর বাড়ি গেলাম। এগুলির মধ্যে মানিকদার পয়সা-মোহরই পছন্দ হল। জিজ্ঞেস করলাম, কতগুলি মোহর লাগবে? মানিকদা উত্তরে বললেন, ‘‘শ’খানেক।’’ শুনে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে দিন পনেরো সময় চেয়ে নিলাম।

মানিকদার বাড়ি থেকে সোজা গেলাম বড়বাজার সোনাপট্টিতে দেবীদত্ত জালানের দোকানে। সেখান থেকে শ’খানেক অব্যবহৃত ভিক্টোরিয়ার তামার এক পয়সা কিনে নিলাম। প্রতিটির দাম পড়েছিল এক টাকা করে। তার পরে এলগিন রোডে শ্যামবাবুর দোকানে সেগুলি রেডিয়াম প্লেটিং করিয়ে নিয়েছিলাম। ফলে তামার এক পয়সা আসল মোহরের মতোই হয়ে গেল। পাশাপাশি রাখলেও তা ধরা অসম্ভব ছিল। পরে থলি ভর্তি মোহর নিয়ে হাজির হলাম মানিকদার বাড়িতে। মানিকদা তো দেখে অবাক। চোখেমুখে বিস্ময়। এর পরে কিঞ্চিৎ চা এবং জলযোগের পরে মানিকদাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। সব শুনে তিনি একেবারে হতবাক! পাশাপাশি আসল মোহর আর প্লেটিং করা তামার পয়সা রেখে মানিকদা বললেন, ‘‘কারও বাবার ক্ষমতা নেই ধরবে।’’ সে দিন মানিকদার মুখে উক্তিটি শুনে মন ভরে গিয়েছিল। ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে বিমলা সন্দীপের সামনে থলি থেকে মোহর ঢেলে দিচ্ছে সেই দৃশ্যে এগুলি ব্যবহৃত হয়েছিল।

ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও মানিকদা ডেকে না পাঠালে তাঁর বাড়ি যেতাম না। এক দিন ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘‘তুমি তো এত কিছু সংগ্রহ করো, যদি স্টিরিওগ্রাম-এর সন্ধান পাও আমার জন্য নিয়ে নিও।’’ বরাত জোরে এ শহরের একটি নিলাম ঘরে সেটি পেয়ে যাওয়ায় মানিকদার জন্য সেটি কিনে নিয়েছিলাম। সেটি হাতে পেয়ে মানিকদার সেই তৃপ্তির হাসিটা আজও চোখে ভাসে।

এক বার মানিকদা কয়েকটি ছোটগল্প অবলম্বনে কাজ করছিলেন। তার মধ্যে আন্তেন চেখভ-এর একটি গল্প অবলম্বনে তৈরি হচ্ছিল ‘কলাকৃতি’। মানিকদা এক দিন ডেকে পাঠিয়ে বললেন, একটা বিশেষ ধরনের মূর্তির প্রয়োজন। তবে পাথরের নয়, অন্য কিছুর। এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে মনে পড়ে গেল আমারই এক বন্ধু পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পারিবারিক সংগ্রহে পোরসেলিনের কিছু দুষ্প্রাপ্য মূর্তি ছিল। অগত্যা তাঁকে ব্যাপারটা জানালাম। প্রায় তিন ফুট উচ্চতার বহুমূল্য একটি বিস্কিট-চায়নার তৈরি মূর্তি মানিকদার প্রয়োজনের সঙ্গে হুবহু মিলে যাওয়ায় সোজা সেটিকে ভাল ভাবে প্যাকিং করে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়ে গেলাম। মানিকদা মূর্তিটার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টে চেয়ে বললেন, ‘‘এটাকে দেখেই কি গল্পটা লেখা?’’

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আরও একটি ঘটনা। পার্থর ছেলে বেনু ভাল পিয়ানো বাজাত। বেনুর ইচ্ছে ছিল এক দিন মানিকদাকে পিয়ানো শোনানোর। এক দিন সেই ইচ্ছের কথা মানিকদাকে জানাতে তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। পরের রবিবার সকালে পার্থ, বেনু ও আমি বিশপ লেফ্রয় রোডে তাঁর বাড়িতে হাজির হলাম। এ কথা সে কথা নানা গল্প হলেও পিয়ানো বাজানোর কথা আর ওঠেই না। এমনটা দেখে আমি পিয়ানোর প্রসঙ্গটা তুললাম। মানিকদাও বলে বসলেন, ‘‘আর এক দিন হলে হয় না?’’ সব দিক ভেবে আমি আবার বললুম একটু শুনিয়ে দিক না হয়। মানিকদা বললেন, ‘‘আচ্ছা বাজাক।’’ অবশেষে বেনুর হল পিয়ানো বাদন। বাজনার শেষে মানিকদা বেনুকে ডেকে বললেন, ‘‘শোনো, কেন আমি বলছিলাম অন্য দিন শুনব তার কারণ হল পিয়ানোটার টিউনিং আজ ঠিক নেই। এক বার ভুল সুর কানে ঢুকলে তা বেরোয় না।’’ আমরা তো হতবাক! এমনই ছিলেন মানিকদা।

তেমনই তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ বেশ কিছু পুরনো মূর্তি আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে যেমন ছিল পাল যুগের কিছু মূর্তি তেমনই ছিল চোল শিল্পকর্মের অর্ধনারীশ্বর।

আজ আমার বয়স আশি। মানিকদার জন্মদিনের আশপাশে এই সব ঘটনা, স্মৃতি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। আসলে সেগুলোর তো বয়স বাড়ে না! বরং সেগুলোই জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দেয়।

ছবি: হীরক সেন।

সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষের সূচনায় লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Roy Satyajit Roy's birthday Parimal Roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE