কিশোর কুমার।
আমার জীবনে বাবা-মায়ের পর যাঁর জায়গা তিনি কিশোর কুমার। আমার ঈশ্বর। আমার ভগবান।
সে অনেকদিন আগের কথা। কৈশোর থেকে সবে যৌবনের দিকে পা দিতে চলেছি। কেন জানি না, কিশোর কুমারের গান অন্য রকম লাগত। ওই উদাত্ত কন্ঠ, গানের মধ্যে নাটক, অসাধারণ এক্সপ্রেশন…। পরে যখন গান গাইতে শুরু করলাম, বুঝলাম, না শিখে যেমন রফি সাহেবের গান গাওয়া যায় না, ঠিক তেমনই না শিখলে কিশোর কুমারের গানও গাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন, গায়িকা পরমা দাশগুপ্তর বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম জানলে অবাক হবেন
১৯৮৪-৮৮ আমি মুম্বইয়ে ছিলাম। কিন্তু কেরিয়ার তৈরি করব বলে তো আর সেখানে যাইনি। আমি ঈশ্বর দর্শন করতে গিয়েছিলাম। স্যরের। কিশোর কুমারকে আমি স্যর বলতাম। স্যরের হাঁটা-চলা, কথা বলা, মাইক ধরার কায়দা এ সব দেখতে গিয়েছিলাম। ওঁর মাইক ধরার বিশেষ কায়দাটা আজও রপ্ত করতে পারিনি।
আরও পড়ুন, এফটিআইআইয়ের নয়া প্রধান হচ্ছেন অনুপম
সে সময় মুম্বইয়ে একটা বই পাওয়া যেত। যেখানে লেখা থাকত, কোন দিন কোন স্টুডিওয় কোন গান রেকর্ড হবে। শিল্পী কে, কোন ছবি, সুরকারের নাম সব দেওয়া থাকত। আমি সেই বই কিনে যেখানেই স্যরের গান থাকত, চলে যেতাম। বলতে পারেন, স্যরের পিছন পিছন দৌড়ে বেড়াতাম। এর পর এল সেই দিনটা!
নিজের তৈরি কিশোর কুমারের মূর্তির পাশে গৌতম।— ফাইল চিত্র।
মানে প্রথম আলাপের কথা বলছি। যা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। মেহবুব স্টুডিওয় এক রেকর্ডিস্ট ছিলেন অভিনন্দন ঠাকুর। আমি তাঁকে বলেছিলাম, এত দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যেখানেই কিশোর কুমারের গান রেকর্ড করতে যাচ্ছেন, চলে যাচ্ছি। এক দিন আলাপ করিয়ে দিন না। উনি বললেন, ঠিক আছে। তাই হবে। তো এক দিন স্যরের সামনে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে প্রথমেই বলেছিলেন, ‘ও! বাঙালির ছেলে। ভেরি গুড, ভেরি গুড।’ এই ভেরি গুডটা মাঝেমধ্যেই বলতেন। তার পর বলেছিলেন, ‘আমার গান গাও? শোনাও তো।’ আমি ‘মেরে ন্যায়না শাওন ভাদু’ শুনিয়েছিলাম চার লাইন। একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘তুমি গানটা খারাপ গাও না, আবার ভাল গাও, এমনটাও নয়। অনেক তৈরি হতে হবে। তবে আমার গান কোনও দিন আমার মতো করে গাওয়ার চেষ্টা কোরো না। তোমার মতো করে গাইবে। দেখবে লোকে ভালবেসে নেবে।’ সেই কথা আমি আজও মেনে চলার চেষ্টা করি।
বাড়িতে কিশোর কুমারের জুতো রেখে পুজো করেন গৌতম।— ফাইল চিত্র।
কোনও শিল্পীকে ছোট না করেই একটা কথা বলতে পারি, কিশোর কুমার এক জনই। আর জন্মাবেন না। আসলে গান তো ঠাকুর গড়ার মতো। মিউজিক ডিরেক্টর কাঠামো তৈরি করে দেন। তাতে রং দিয়ে সম্পূর্ণ করাটা তো শিল্পীর কাজ। একটা ঘটনা বলি। সুজিত গুহ একটা ছবি করেছিলেন, আশা-ভালবাসা। সেখানে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আর বাপ্পি লাহিড়ির সুরে একটা গান গেয়েছিলেন কিশোর কুমার, ‘নটবর নাগর তুমি করো না মস্করা’। গানের আগে পুলক বাবুকে ডেকে স্যর জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই নটবরটা কে? পুলকবাবু বলেছিলেন ভিলেন। তখন কিশোর কুমার বলেছিলেন, ‘নটবর কে জানেন? এ তো শ্রীকৃষ্ণের নাম। এমন অসাধু একটা লোকের নাম নটবর হল কেন? হঠাত্ করে গানটা শুরু হলে জমবে কি না আমার সন্দেহ আছে। আমি একটু জমিয়ে দেব?’ আপনারা লক্ষ করবেন, ওই গানটা শুরুর আগে উইদআউট মিউজিক একটা ডায়লগ আছে, ‘যা যা যা যা গোপাল, যা ব্যাটা গরু চড়া’— ওটাই স্যরের জমিয়ে দেওয়া। এমন অজস্র গল্প রয়েছে। গল্প তো নয়, এ সব সত্যি ঘটনা।
১৯৮৭-র ১২ অক্টোবর শেষ গান গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। — ফাইল চিত্র।
১৯৮৭-র ১২ অক্টোবর শেষ গান গেয়েছিলেন স্যর। ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’ ছবিতে ‘অ্যায় গুরু গুরু…’। সেটা কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলের ডুয়েট ছিল। মিঠুন চক্রবর্তীর লিপে কিশোরজির শেষ গান ছিল। তার পরের দিনই চলে গেলেন।
কপালে চন্দন নিয়ে আমার ঈশ্বরের শুয়ে থাকার ছবিটা আমি আজও ভুলতে পারি না!
অনুলিখন: স্বরলিপি ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy