Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ওই চাহনি, ওই হাসি এবং উত্তমকুমার

বাঙালির কাছে উত্তমকুমার মানে ঠিক কী? প্রশ্নটা শুনে তাই অনেকেই হাসবেন। বলবেন, মহানায়ক আবার কী! এ নিয়ে সংশয় আছে নাকি!

পুলক মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৮ ০২:০৩
Share: Save:

তখনও। এখনও। তখনও তিনি পর্দা কাঁপাতেন। এখনও টেলিভিশনে তাঁর ছবি থাকলে দেখতে ভুল করে না দর্শক।

বাঙালির কাছে উত্তমকুমার মানে ঠিক কী? প্রশ্নটা শুনে তাই অনেকেই হাসবেন। বলবেন, মহানায়ক আবার কী! এ নিয়ে সংশয় আছে নাকি!

সত্যিই কি শুধু তাই? মহানায়ক পরিচয় ছাপিয়েও আমবাঙালির কাছে যে উত্তমকুমার বড় আপন, তিনি হলেন সেই চিরন্তন প্রেমিক। তাঁর সেই ট্রেডমার্ক ভুবনভোলানো হাসি, যাতে কাত হয়ে যান আঠারো থেকে আশি। ওঁর বুলি-চাহনি, রাগ-অভিমান, যা তুফান তোলে নারী-মনে। এক কথায়, বাঙালি সেলুলয়েডে উত্তমকুমার আজও ‘রোম্যান্টিসিজম’-এর শেষ কথা। সাধে কী আর বাঙালি জীবনের একটা বিরাট অধ্যায় জুড়ে শুধুই উত্তম।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাঙালি ‘রোম্যান্টিসিজম’-এর স্রষ্টা নিঃসন্দেহে এক এবং রবীন্দ্রনাথ। আজও প্রেম নিবেদনের জন্য নব্যশিক্ষিত যুবক-যুবতীর আশ্রয় রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতার উদ্ধৃতি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজ আসনে অটল। কিন্তু বাঙালি নারীর রোম্যান্টিক পুরুষ ‘আইকন’-এর জায়গাটি দখল করে রয়েছেন এক এবং অদ্বিতীয় উত্তমকুমার। রবীন্দ্র-কবিতা বা গান, সংলাপ বলার পারদর্শিতায় ঝরে পড়া ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’-এ উত্তমকুমারের বিকল্প কোথায়? এটাও সত্য, বহু বাঙালি ললনা আজও প্রেমিকের মধ্যে উত্তমকুমারকেই খোঁজে।

অথচ উত্তমকে কি তথাকথিত ‘সুপুরুষ’ বলা চলে? এ নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। অনেকেরই মত, একটু ভারী গোছের চওড়া মুখ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট, মোটামুটি উচ্চতা— সব মিলিয়ে যেন গড়পড়তা বাঙালির বেশি কিছু নয়। তবু ‘প্রেমিক উত্তম’-এ কেন আজও বাঙালি মন্ত্রমুগ্ধ? কী সেই রসায়ন, যাতে দশকের পর দশক মজে আছে বাঙালি? এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও উত্তম-ক্যারিশমা অটুট। পোর্ট কমিশনার্সের এক সামান্য কেরানি অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় কী করে হয়ে উঠলেন বাঙালির রোম্যান্টিক বিপ্লবের অবিসংবাদী নায়ক? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “উত্তমকুমার ছবিতে যে প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করতেন, তার থেকে বলরাজ সাহনি বা দিলীপ কুমার অনেক বাস্তবসম্মত অভিনয় করতেন। কিন্তু, ইচ্ছাপূরণ করতে পারতেন উত্তম। তিনি এক রোম্যান্টিক কল্পনার চিত্র রূপায়ণ করতেন।” একই সঙ্গে সেলুলয়েডের পর্দায় নিজেকে ‘লেডিজ হার্টথ্রব’ রূপে তুলে ধরে বাঙালি পুরুষকে নারী হৃদয় জয়ের এক অজানা কৌশল শিখিয়েছিলেন উত্তম।

এখানেই তিনি অনন্য। ব্যতিক্রমও।

‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে কবিগানের দল নিয়ে কলকাতা যাওয়া ঠিক করেছেন অ্যান্টনি ওরফে উত্তম। কিন্তু, তার আগে চাই নিরূপমার (নায়িকা তনুজা) অনুমতি। এই অনুমতি চাওয়ার প্রাক-মুহূর্তে উত্তম বলেন— “আমি কি যাব?” এই কথাটা বলার সময়ে একটা চোখ বন্ধ করে ঠোঁটটা একটু ফাঁক করে, এ বার বকুনি খেতেও পারি গোছের যে অভিব্যক্তিটা উত্তম দেখান, তা আসলে যে বউকে নকল সমীহ আর ভালবাসার চিরন্তন থিওরি মেনে চলা আমবাঙালিরই প্রতিনিধিত্ব করা, তা সেলুলয়েডের পর্দা থেকে নিমেষে ছুঁয়ে যায় দর্শক-হৃদয়। নারীর একান্তপুরুষ হয়ে ওঠার তাগিদে প্রেমিক যে ছলনা করে, এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। বাঙালি পুরুষ তার প্রিয় নারীকে প্রেম নিবেদনই করুক অথবা ‘বাঁচাও মরেছি যে প্রেম করে’ বলে খুনসুটি, নারীর পছন্দের সবকটি আইটেমেই চাই ‘উত্তমোচিত’ অভিব্যক্তি।

মধ্যবিত্ত বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক রূপে উত্তম ধরা দিয়েছেন বাঙালি কল্পনায়। যিনি তারকা হবেন, যিনি আমজনতার ‘রোল মডেল’ হবেন, তাঁকে জনতার রুচি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কল্পনাবোধ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। যুবক-যুবতী থেকে প্রৌঢ়, বিগতযৌবনা সব ধরনের দর্শকের কল্পলোকের সঙ্গে সেলুলয়েডের যোগ স্থাপন করতে গেলে যে রসায়ন চাই, তার সবটাই আয়ত্ত করেছিলেন উত্তম। পোশাক নির্বাচনেও ছিলেন পূর্ণমাত্রায় সচেতন। যত দিন স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শ আর বিপ্লবীয়ানা বাঙালির মনে বেঁচে ছিল, তত দিন তাঁর ‘পেটেন্ট পোশাক’ ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি। বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বপ্ন যতই পশ্চিমমুখী হয়েছে, ততই উত্তমের শরীরে উঠে এসেছে আধুনিক ফ্যাশনের শার্ট-ট্রাউজার্স। ধুতি পরিহিত উত্তমের পাশাপাশি সমান জনপ্রিয় হয়েছেন বিদেশি পোশাকের উত্তম। শিক্ষিত বাঙালি যুবক উত্তমের অনুকরণে ভুল উচ্চারণে হলেও ইংরেজি বলা শুরু করল প্রেমিকার সামনে। দেখতে দেখতে উত্তম হয়ে উঠলেন বাঙালির ‘স্টাইল আইকন’।

‘বসন্ত বিলাপ’-এর সেই অমর হয়ে যাওয়া দৃশ্য মনে আছে নিশ্চয়। পুকুর পাড়ে প্রেমিক চিন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বসেছেন প্রেমিকা জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। একটু হাতে হাত, একটু চোখে চোখ রেখে গদগদ চিন্ময় হঠাৎ জুঁইকে বলে ওঠেন, ‘তুমি আমায় একবার উত্তমকুমার বলো!’

চার সাড়ে চার দশক আগে থেকেই নিজেকে উত্তমকুমার ভাবতে থাকা বাঙালির অস্তিত্ব আজও বিলীন হয়নি। পেশির আস্ফালন বা সিক্স প্যাক মানেই তো আর পৌরুষ নয়, বরং ব্যক্তিত্ব আর রসবোধের সংমিশ্রণ আজও বাঙালি নারীকে টানে। আর এখানেই বাঙালির অবচেতনে কাজ করে ‘উত্তম ফ্যাক্টর’। বাঙালি রোম্যান্সে আজও তাই উত্তম অপরাজেয়, কালজয়ী।

লেখক শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE