Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

এইখানে অনেক রকম স্বাধীনতা

একটি ভূখণ্ডের মাপে ধরা দেবে না মানুষরতন, কিছুতেই। তাই সে কখনও পাখি, কখনও ম্যানহোল, কখনও সমুদ্র হয়ে যায়! অন্য রকম স্বাধীনতা ছুঁয়ে দেখলেন শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়একটি ভূখণ্ডের মাপে ধরা দেবে না মানুষরতন, কিছুতেই। তাই সে কখনও পাখি, কখনও ম্যানহোল, কখনও সমুদ্র হয়ে যায়! অন্য রকম স্বাধীনতা ছুঁয়ে দেখলেন শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র

অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

পাখি

রাস্তার ধারের ধানক্ষেতের দিকে চোখ পড়লেই দেখা যেত তাকে। শীতের রোদ্দুরে বসে থাকত সে। একটা চারচাকাওয়ালা প্রতিবন্ধীদের গাড়িতে। হকিন্সের মতো।

মা, কলকাতা-ডায়মন্ড হারবারের পিচরাস্তা সারাইয়ের কাজে যেত কিংবা নগরীর উন্নয়নের নতুন রাস্তা তৈরির কাজে। যাবার আগে ছেলেটাকে বসিয়ে যেত, দাওয়ায়। দাওয়া শেষ হলে সেই ধূ ধূ জমির শুরু। সবুজেরও।

ছেলেটার বয়স তখন সতেরো, নাকি সদ্য আঠারো! ওর অসুখ একটাই। ওর শরীরের কোষগুলো শুকিয়ে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এত দ্রুত যে এখন ডাক্তারদের কথা শুনে শুনে ওই ছেলেও জেনে গিয়েছে, এই সব অসুখে মানুষ এত বেশি দিন বাঁচে না। কেমন করে যেন বেঁচে আছে সে। ওর বোধবুদ্ধি, কল্পনায়, মস্তিষ্কের কাজের কিন্তু কোনও ক্ষতি হয়নি। সেই বিজ্ঞানী হকিন্সের মতোই। শুধু চলাফেরা, মুভমেন্টেরই যত অস্বস্তি, অসুবিধা। তাই ডাকঘরের অমলের মতোই সে শুধু বসে থাকে ওই ধানজমির আলের ধারের পাশে, দু’চোখের পাল্লা খুলে। ঘরের ভিতর সে কিছুতেই থাকবে না। কুঁড়েঘর, বেড়ার ঘর, পাকা ঘর, হসপিটালের ঘর— কোথাও তার ভাল লাগে না। ওই সদ্য যুবকের স্বাধীনতা কিংবা মুক্তি হয় যখন সে একমাত্র ওই আকাশের নীলের নীচে আর ধানের সবুজ দিগন্তের কাছে যায়। বসে থাকে। অন্যত্র কদাপি নয়। সেই জন্যই ওর মা, ওই বাইরেটাতেই বসিয়ে রেখে যায় ওকে।

ভরসা আশপাশের খেতের কিছু লোকেরা, ক্ষেতমজুরেরা। আর একটা কুকুর। চমৎকার স্টোরি টেলার ওই ছেলে। আমার সঙ্গে তার গপ্পোকথার সম্পর্ক। সময় কাটানোরও।

একদিন ওই যুবককে আমি প্রশ্ন করি, সারা দিন এইখানে বসে থাকো, যত ক্ষণ না সন্ধ্যের পর তোমার মা ফিরে আসেন। তো সমস্ত দিন ধরে এক জায়গায় বসে বসে কী দেখো তুমি! স্টোরিটেলার তার নতুন ঝকঝকে চোখদুটো দিয়ে আমাকে দেখে। আমি আবার বলি, ‘কী দেখো?’ অনেকক্ষণ পরে তার উত্তর আসে। ‘আমি দেখি, পাখিদের। পাখিরা ডানা মেলে আসে ফের উড়ে যায়। ছোট পাখি। বড় পাখি। সকলেই একই ভাবে ওড়াওড়ি করে। কিন্তু...’

‘কিন্তু কী!’

‘দেখবেন, মাটি থেকে যখন এক একটা পাখি আকাশের দিকে উড়ে যায়, কিংবা ডানা মেলে হয়তো মাটির দিকে নামছে, তখন রোদ্দুরে তাদের ডানার যে ছায়াগুলো মাটিতে পড়ে, নামার সময় বা ওপরে ওঠার সময়তেও- তা একই ভাবে মিলিয়ে যায় না। এক এক জনের ছায়ার অস্তিত্ব এক এক রকম।

আমি বলি, ‘হ্যাঁ, তো!’

স্টোরিটেলার বলে, আমি রোজ এইখানে বসে বসে, সেই জায়গাটা খুঁজি। সেই নির্দিষ্ট বিন্দুটা, যেখান থেকে মিলিয়ে যায় পাখিদের ছায়া। মাটি থেকে, আকাশে উড়ে যেতে যেতে। দেখেছি এক এক জনের মিলিয়ে যাওয়া এক এক রকম। কে যে কখন, কোন বিন্দুতে খুঁজে পাবে ফ্রিডম, সে কথা কেউ বলতে পারে না। পারে নাকি স্যার!’

ম্যানহোল

মা কাগজ কুড়োয়, কলকাতার রাস্তায়। মেয়ের বয়স তখন চার-পাঁচ। মেয়েকে একটা পরিত্যক্ত ম্যানহোলের ভিতর লুকিয়ে রেখে যায়। মেয়েটি ম্যানহোলের অন্ধকারের ভিতর লুকিয়ে বসে থাকতে থাকতে, লোহার ঢাকনার ফাঁকে চোখ রেখে লুকিয়ে দেখে এই নতুন দেশ, ইন্ডিয়াকে। এই ভাবে শুধু চটি-জুতো দেখা যায় বড়জোর। কিংবা পোকামাকড়, ধুলোবালি আর আলো-অন্ধকার। বাংলাদেশ থেকে সবে এসেছে ওরা। বেলাইনে। বর্ডার টপকে। মা বলেছে পইপই করে, মুখ কুলুপ মেরে থাকতে। তাই সে মেয়েকে চট করে কেউ দেখলে ভাবে বুঝি বোবা, মুখে কুলুপ যে! একদিন মেয়েটি কৌতূহলে ম্যানহোলের সেই চাপা দেওয়া ঢাকনা আর একটু জোর দিয়ে ঠেলে সরাতেই দেখে এক আশ্চর্য জিনিস। ঢাকনাটি যেন আপনা থেকেই খুলে গেল আর গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে এক লোল-চামড়া বৃদ্ধ। চোখে চশমা, টাক মাথা, লুঙ্গি ফতুয়া, কপালে টিপ। বৃদ্ধের ফোকলা হাসিতে ভয় পেতে না পেতেই পাশের ফুটের এক দিদা এসে লোকটাকে তাড়ায় বটে সে দিনের মতো। কিন্তু দু’দিন পরে ওই বৃদ্ধেরই ভাঙা লোহা কাগজ বিক্রির দোকানে মা ওকে রেখে দিত। ওর কাজ হল, দোকান ঝাড়ু দেওয়া দু’বেলা। আর দাদুর কথামতো এটা ওটা সেটা হাতে হাতে দেওয়া। দাদুই পরামর্শটা দিয়েছিল। এতে সুবিধা মায়েরও। সারা দিনের কুড়নো কাগজ দাদুর দোকানে বিক্রি হবে, আবার মেয়েটারও হিল্লে হবে। ম্যানহোলের অন্ধকারে থাকার বদলে দাদুর দোকানে ঠাঁই হবে। কিন্তু এ-ও যে আর এক ম্যানহোলের মতো অন্ধকার জায়গা তা বোঝা গেল যে দিন মেয়ে তার মাকে কেঁদে বলল, ওই দাদুর অন্ডকোষে সে লাথি মেরে চলে এসেছে। আর যাবে না ওইখানে। কেননা দাদু তাকে কেবলই লুঙ্গি তুলে যা তা কথা বলে, যা তা কাজ করতে বলে। স্বভাবতই পর দিন থেকে মা’র কাগজ বেচার কাজটা যায়। মেয়েরও। ওরা ফিরে আসে ফের সেই গাছতলায়। যার কাছেই ছিল সেই পরিত্যক্ত ম্যানহোল।


ঠিক পরের ম্যানহোল হিসাবেই বাছা হল একটা ভাতের ইসকুলকে। সকালে টিফিন, দুপুরে ভাত দেয় গরিব ফুটের শিশু-কিশোরদের। ওষুধবিষুধও দেয়। জামাকাপড়ও। বিনিময়ে আবার প্রাইমারি এডুকেশনও দেয়। যথা অ, আ, ক, খ, এ, বি, সি, ডি কিংবা ধারাপাতের থেকে এক এক বারে বড় স্কুল যাওয়া অবধি ব্যবস্থা করে দিতে পারে ওরা। লেগে থাকল মা, মেয়েকে সেখানেই রাখল। দিনেরবেলাটায়। এইখানে সকলেই মেয়েটিকে পছন্দ করে। কেননা সে কিছুতেই মুখে রা কাড়ে না। সব সহ্য করে। মুখে কুলুপ। এই নতুন ম্যানহোলে থেকে সে এত উন্নতি করল যে পরবর্তী ম্যানহোল হিসাবে তার ঠাঁই হল, অনাথ আশ্রমে। প্রাইমারি শিক্ষা শেষ! উচ্চশিক্ষা এ বার! এত দিনে সে ইন্ডিয়ার বা কলকাতার ভদ্রতা, সভ্যতা, শিক্ষার রকমফের যা শিখেছে বুঝেছে তাতে মেয়েটির স্বাধীনতা বেড়েছে বটে বেঁচে থাকার। কিন্তু মায়ের দুঃখ অপরিসীম হয়েছে। কেননা মেয়ে চাইছে না সেই কাগজকুড়ুনি মা ওই আশ্রমে রোজ তার খবর নিতে আসুক। কেননা, অন্য মায়েরা বড়লোক অপেক্ষাকৃত। তবু মা যায়। মেয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যায়। এই নতুন উচ্চশিক্ষার দেশে এসে, সেই অনাথ আশ্রমের পরিবেশে থাকতে থাকতে একদিন তার নাচ-গান-কবিতা বলা— এই সব কালচারে মুগ্ধ হয়ে এক মাস্টার তাকে হারমোনিয়াম কিনে দিল।

মেয়েটি দশ ক্লাস পাশ করল না বটে, কিন্তু ওই অনাথ আশ্রম থেকে বেরোবার পর, সে আর কিছুতেই ফুটপাথের এলাকায় যেতে চাইল না। বাংলাদেশ থেকে এসে নিজের বাবা, তাকে নিয়ে গিয়ে সীমান্তে বেচে দিতে চাইলে মা সেই ভাতের স্কুলের মাস্টার-দিদিমনিদের ধরে, এ দেশের লোকেদের পায়ে পড়ে মেয়েকে রক্ষা করেন।

মেয়ে তখন ফ্রিডম চিনেছে নতুন। নাটকের মঞ্চে সে উঠে নৃত্য-গীত-অভিনয় সামান্য করলেই হাততালি পড়ে। লোকে বলছে, ‘এ কালের বিনোদিনী’। তাকে নিয়ে দূরদর্শনে চলচ্চিত্র হচ্ছে। তথ্যচিত্র করছে কত জনে, কত লোক কাগজের স্টোরি করছে। এমতাবস্থায় একদিন এক ফ্ল্যাটবাড়ির এক সরকারি চাকুরি করা সাহসী যুবক মেয়েটির প্রেমে পড়ে। কিছুদিন পর তাদের বিয়ে হয়। সন্তান হয়। ধীরে ধীরে সংসারের-ম্যানহোলের ভিতর তার ঠাঁই হয়। কিছুকাল আগেই যে মেয়ে শিল্পচর্চা কিংবা অভিনয়ের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিল নিজের মুক্তি কিংবা স্বাধীনতা, যা ইতিপূর্বে ইন্ডিয়া বা বাংলাদেশের মতো কান্ট্রিতে আগে সে পায়নি। সেই জগৎ থেকে তাকে খুব তাড়াতাড়ি সরে যেতে হল। কেননা, নতুন নিশ্চিত জীবনে বা সংসারে, দায়দায়িত্ব ঢের। সময় কম। অনুমতি নেই।

ইতিমধ্যে মেয়েটির মা মরেছে। বাবাও। যখন এই দেশে সে এসেছিল তখনকার জীবনের থেকে আজ সে অনেক অনেকটা উচুঁতে বসবাস করে। স্বামী-সন্তান, শ্বশুরবাড়ি সব কিছুর ভিতরেই সুন্দরভাবে সে নিজেকে ধরিয়ে নিয়েছে। এখন সে এই দেশেরই এক মেয়ে যেন। এখানেই তার সর্বস্ব। তবু মাঝে মাঝে মেয়েটাকে ইস্কুলের কারিকুলাম মেনে গান শেখাতে বসালেই হঠাৎই সেই পুরনো হারমোনিয়ামটার কথা তার মনে পড়ে।

সেই হারমোনিয়ামের রিডের মতো সাদা-কালো দিনগুলোর কাঁটাতারের ভিতর থেকেই যে একদিন সে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল আজকের এই নতুন জীবনে। মাটির তলার ম্যানহোলের অন্ধকার থেকে এই অনেক উচুঁর আলোকিত নিজেদের নতুন কেনা বাড়িটাতে। হারমোনিয়ামটা না ছাড়লে, এটা হত না। এ কথা ঠিক। আচ্ছা এখন কি একবার চেষ্টা করা যায় না। ফোন করে সে হারমোনিয়াম ম্যাস্টরকে।

সে: স্যার! একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন না।

ম্যাস্টর: না। কী শুনি!

সে: আমার পুরনো হারমোনিয়ামটা আপনাদের কাছে আছে, দেবেন!

ম্যাস্টর: কেন হঠাৎ?

সে: আমার মেয়েকে গান শেখাব।

ম্যাস্টর: না।

সে: কেন?

ম্যাস্টর: তুমি তো আর গান কর না। যারা করে, তারা এখন ওই যন্ত্রটাতেই শেখে যে!

সে: কিন্তু ওটাতো আমারই ‘হারমোনিয়াম’।

ম্যাস্টর: ছিল। এখন আর নয়।

ফোন কেটে গেল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম-ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে বাচ্চা মেয়েটা আবার দেখবার চেষ্টা করছে বাইরের দুনিয়াটাকে।

সমুদ্র

অন্ধের কাছে অন্ধেরাই যায়। এ কথা সর্বদা ঠিক নয়। একবার এক অন্ধ মেয়ের শরীরের-গান কিংবা গানের-শরীর এতখানি মুগ্ধ করল এক চক্ষুষ্মান যুবককে, যে হঠাৎ মেয়েটি একদিন যখন কলেজ থেকে ফিরছে, ছেলেটি বলল তাকে, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব। আমি তোমার নতুন চোখ। দয়া করে আমাকে ফিরিও না।’ মেয়েটি অন্ধ হলেও তখন খুব খ্যাতি তার— গানের মতো রূপের আর রূপের মতো গানেরও। কিন্তু এ ঘটনার অনেক আগে থেকেই আর এক প্রায় জন্মান্ধ যুবক ওই মেয়েকে ভালবাসে। সে ছেলেটিও অসম্ভব প্রতিভাধর। লেখাপড়া, গানবাজনা, খেলাধূলা— সব কিছুতেই চ্যাম্পিয়ন। অন্ধ স্কুলের নাম করা ছাত্র। কিন্তু তাতে কী! অন্ধের কাছে চক্ষুষ্মানের মূল্য অনেক বেশি। এমনকী সে নির্বোধ হলেও। এটা অনেকটা গরিবের কাছে বড়লোকের মতো, মূল্যবান। স্বভাবতই আমাদের চেনা গানের মেয়েটি চক্ষুষ্মানকেই তার সঙ্গী করে সংসারে ঢুকল। তারপর বছর ঘুরতেই সন্তান হল। আরও দু’-এক বছর যেতে না যেতেই মেয়েটি তার কোলের সন্তানটিকে নিয়ে পথে পথে ঘুরতে শুরু করল, নতুন আশ্রয়ের খোঁজে। কেননা, চোখে বেশি দেখে বলে এ অন্ধ মেয়ে যাকে বিয়ে করেছিল, সেই বেশি দেখার কারণেই, সে চলে গেছে তাকে ছেড়ে। শুনেছি এ সময় সে প্রায়ই জলের কাছে যেত, এক নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকত ছেলেকে নিয়ে। যাক, মেয়েটি তবু লেগে রইল ধর্ম মনে করে তার গানের জগতের সঙ্গে। গানের ভিতর দিয়েই তখন সে কিছুটা মুক্তি পায়, স্বাধীনতা পায়, ফ্রিডম বোধ করে। সন্তানপালন করে একা একা। বেঁচে থাকবার লড়াইটা চালায় একা একা। তখনও গানের মতো রূপ ঝরে যায়নি তার।

একদিন সমুদ্রের ধারে গানের দল গেছে প্রোগ্রাম করতে। পুরী নাকি দিঘা মনে নেই। মেয়েটি তার ছেলেকে নিয়ে বসে আছে বিকেলের বালিতে। জল আসছে। জল যাচ্ছে। অন্ধ মা সমুদ্র-মুখো হয়ে বসে আছে চুল খুলে। ছেলে তখন হাঁটি হাঁটি পা সবে। ছেলে, দেখতে পায় চোখে। মা গান গাইছে আকুল হয়ে। ছেলে এরই মধ্যে কখন মার হাত খসে বালিতে নিজের পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে চলে গেছে জলের কাছে। সমুদ্রের দিকে। ঢেউ আসছে। ঢেউ যাচ্ছে। অন্ধ মা হয়তো তার চোখের ভিতর দিয়ে দেখছিল তখন দূর-সমুদ্দুরের কোনও রূপ। আর আমরা দেখছি জলের তোড় এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই মায়ের চোখের সমুখ থেকে তার চক্ষুষ্মান শিশুকে।

তখন বিকেল পেরিয়ে বুঝি, সন্ধ্যা। আমরা ছুটে গিয়ে বাঁচাচ্ছি শিশুটিকে। কিন্তু সে কথাটা তত বড় নয়। যত বড় সেই মুহূর্তে মেয়েটির গানের কথাটা সে গাইছিল, ‘আরও আলো, আরও আলো। এই নয়নে প্রভু ঢালো’। কে যেন বলেছিল, ‘তা বলে রবীন্দ্রনাথ! কানারও কালচার!’

শেষ কথা

প্রান্তিক-প্রতিবন্ধী কিংবা নিচুতলার মানুষের জীবনের কোনও স্ব-কাল নেই। স্ব-দেশ নেই। তাই তেমন বলবার মতো স্বাধীনতাও নেই। ফ্রিডম, হাসির কথা। তবু এইখানে যে অদ্ভুত স্টোরিটেলার কিংবা এক আশ্চর্য অভিনেত্রী আর আর এক তুলনাহীন অন্ধ-গায়িকার কথা বলা হল, তাদের জীবনের সামান্য ভূখণ্ড জুড়ে শিল্পচর্চা ছিল বলে জানি। আর এ-ও জানি সেই সময়টুকুতেই শিল্পচর্চার আশ্রয়ে বা শুশ্রুষায় তারা প্রত্যেকেই হয়ে উঠত সত্যিকারের স্ব-অধীন বা স্বাধীন মানুষ। কোনও বেড়া বা কাঁটাতার, কোনও ছোটলোক বা বড়লোকের নিষেধের গণ্ডি, কোনও কিছুই তখন যেন তাদেরকে ছুঁতে অবধি পারত না। আমার চোখে তখন ওরা প্রত্যেকেই হয়ে উঠত আশ্চর্য মানুষের মতো প্রকৃত অলীক। যেমন পৃথিবীর সব আর্টিস্টই হয়, কিছুটা সময়।

তবু আমি জানি না সেই ধানখেতের যুবক তার মৃত্যুর আগে জেনেছিল কি না সেই নির্দিষ্ট উচ্চতার বিন্দুটিকে, যেখান থেকে সব পাখিদের ছায়া মিলিয়ে যায় মাটি থেকে। কিংবা সেই ছিন্নমূল বাচ্চা মেয়েটা আজও তার সেই হারমোনিয়ামটা খুঁজতে খুঁজতে কোনও ম্যানহোলের দিকে নিজেকে নিয়ে চলেছে। অন্ধ মেয়েটি কি এখন ‘নতুন চোখ’-এর অপেক্ষায় সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে, যেখানে তাদের দেখা হয়েছিল একদিন। কে জানে!

এইখানে স্বাধীনতা অনেক রকম। অনেক প্রকার। একটি মাত্র কাঁটাতারে তাকে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। একটি ভূখণ্ডের মাপে ধরা দেবে না মানুষরতন, কিছুতেই। তাই সে কখনও পাখি, কখনও ম্যানহোল, কখনও সমুদ্র হয়ে যায়!

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shubhashis Gangyopadhyay independence day 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE