Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আঙুল জুড়ল ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও

চিকিৎসকের সদিচ্ছা থাকলে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও যে কাটা আঙুল জোড়া লাগানো সম্ভব এ বার সেটাই করে দেখাল পুরুলিয়ার বারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ৯ বছরের একটি মেয়ের কাটা কড়ে আঙুল গত রবিবার জোড়া লাগিয়েছেন ওই স্বাস্থ্যেকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী।

আঙুল পেয়েছে মনিকা। (ডান দিকে) চিকিৎসক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।

আঙুল পেয়েছে মনিকা। (ডান দিকে) চিকিৎসক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।

সমীর দত্ত
বোরো শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৫ ০২:০৮
Share: Save:

চিকিৎসকের সদিচ্ছা থাকলে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও যে কাটা আঙুল জোড়া লাগানো সম্ভব এ বার সেটাই করে দেখাল পুরুলিয়ার বারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ৯ বছরের একটি মেয়ের কাটা কড়ে আঙুল গত রবিবার জোড়া লাগিয়েছেন ওই স্বাস্থ্যেকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। এখন সেই আঙুল নড়ানোও যাচ্ছে। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেহাল পরিকাঠামোর মধ্যেই এই জটিল অস্ত্রোপচার করায় তাজ্জব এ রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ওয়াকিবহাল চিকিৎসকেরাও।

পুরুলিয়ার শহরেরই এক বাসিন্দার দুর্ঘটনায় আঙুল কাটা পড়েছিল। রাস্তার ধুলো থেকে তুলে নিয়ে আসা সেই আঙুলই পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে জোড়া লাগিয়েছিলেন শল্য চিকিৎসক পবন মণ্ডল। তারপর সেই জেলারই জঙ্গলমহলের মানবাজার ২ ব্লকের প্রত্যন্ত এলাকার এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অস্ত্রোপচার আশার কথা বলেই মনে করছেন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘পরিকাঠামোর ঘাটতির মধ্যেও এই অস্ত্রোপচার নিঃসন্দেহে প্রশংসার। আশাকরি অন্য চিকিৎসকদেরও এই প্রচেষ্টা উদ্বুদ্ধ করবে।’’

মণিকা মান্ডি নামের ওই বালিকা বরাবাজারের জিলিং গ্রামে দাদু ও ঠাকুমার সঙ্গে থাকে। তার বাবা ও মা বাইরে কাজ করেন। মণিকা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। তার দাদু কৃপাসিন্ধু মান্ডি জানান, গত রবিবার সকালে তিনি জ্বালানির জন্য কাটারি দিয়ে শুকনো ডাল কাটছিলেন। মণিকা তখন উঠোনে খেলা করছিল। কৃপাসিন্ধুবাবু সামান্য সময়ের জন্য আমি বাড়ির ভিতরে গিয়েছিলেন। হঠাৎ নাতনির আর্তনাদ শুনে বাইরে দৌড়ে আসেন। তাঁর কথায়, ‘‘দেখি মণিকা উঠোনে পড়ে ছটপট করছে। তার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের কিছুটা অংশ কেটে ফেলেছে। মাটি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কাটারি দিয়ে কাঠ কাটকে গিয়েই সে আঙুলে চোপ মেরেছে।’’

মণিকার ঠাকুমা সুন্দরী মান্ডি সঙ্গে সঙ্গে নাতনির আঙুলে কাপড় বেঁধে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কাটা আঙুলটা যদি কোনও জোড়া লাগানো যায়, এই ভেবে তাঁরা সঙ্গে নিয়ে নাতনিকে আড়াই কিমি দূরের বারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। তখনও কি ভেবেছিলেন ওই কাটা আঙুলই জোড়া লাগবে!

অনিরুদ্ধবাবু জানান, তিনি মণিকাকে দেখে প্রথমেই রক্ত বন্ধ করার ওষুধ দেন। তার বেশি চিকিৎসা ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে সম্ভব নয়, তিনি কৃপাসিন্ধুবাবুকে তা জানিয়ে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে মণিকাকে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তাঁরা জানিয়ে দেন, খুব দরিদ্র। পুরুলিয়া নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। এখানেই যা করার করতে হবে।

ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্লক মেডিক্যাল আধিকারিক ছাড়া সাতজন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু রয়েছেন ব্লক মেডিক্যাল আধিকারিক-সহ তিনজন। তাঁর মধ্যে বিএমওএইচকেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডিউটি করতে যেতে হয়। নার্সিং স্টাফ থাকার কথা ১১ জনের। রয়েছেন সাতজন। গ্রুপ ডি পদেও চারজনের ঘাটতি রয়েছে। রবিবার সেই সময় বিএমওএইচ অন্য একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসায় গিয়েছিলেন। অনিরুদ্ধবাবুর কথায়, ‘‘এখানে বড় হাসপাতালের মতো সুযোগ-সুবিধা নেই। তাও হাউস স্টাফশিপ করার সময় অ্যানাসস্থেসিয়া ও অর্থোপেডিক্সের বিষয় নিয়ে সামান্য জ্ঞান ছিল। সেটাই অবলম্বন করে মণিকার কাটা আঙুলটা জোড়া লাগানোর একটা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরেও কাটা আঙুল কতটা সাড় দেবে এ নিয়ে আমি নিজেও সংশয়ে ছিলাম।’’ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্স বেবি মাহাতো বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু ওটি রেডি করতে বলেন। আমি প্রায় এক দশক নার্সিং করছি। কিন্তু এখানে এ ধরনের জটিল অস্ত্রোপচার এর আগে কখনও হয়নি। তবু চিকিৎসকের কথামতো সরঞ্জাম রেডি করলাম। তখনও ভাবতে পারিনি ওই আঙুল জোড়া লাগবে, নড়ানো যাবে।’’

অনিরুদ্ধবাবু জানান, এখানে ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই, শল্যা চিকিৎসকও নেই। আঙুল সোজা রাখার মতো উপযুক্ত সরঞ্জাম নেই। তার বেঁকিয়ে আঙুল সোজা রাখার একটা ব্যবস্থা করেন তিনি। দুই স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে তিনি ঘণ্টা দেড়েকের চেষ্টায় আঙুলের কাটা অংশ জোড়া লাগান। এখন সেই আঙুল নাড়ানো যাচ্ছে দেখে মণিকার পরিবারের মতোই অবাক ওই চিকিৎসকও। এখন ওই স্বাস্থ্যেকেন্দ্রেই ভর্তি রয়েছে মণিকা। খবর পেয়ে এসেছেন তার বাবা শান্তিরাম মান্ডি। তিনি বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু আমার মেয়ের জন্য যা করেছেন জীবনে ভুলতে পারব না।’’

তবে এখনই মণিকা ছাড়া পাচ্ছে না। অনিরুদ্ধবাবু জানান, মণিকার আঙুল সাড়া দিচ্ছে। সে নাড়াতেও পারছে। তবে এখনই তাকে ছাড়া হবে না। অন্তত এক সপ্তাহ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেখে তারপর ছুটি দেওয়া হবে। আর পুরুলিয়ায় যুবকের কাটা আঙুল জোড়া দেওয়া শল্যা চিকিৎসক পবন মণ্ডলের পরামর্শ, ‘‘আমি আশা করব তিনি সফল হবেন। তবে এই ধরনের চিকিৎসায় সময় লাগে। ক্ষতস্থান লক্ষ রাখতে হয়। তবে সংবেদনশীল অংশগুলি ধীরে ধীরে সাড় আসতে থাকে। তাড়াহুড়ো করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। ওই বালিকাকে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণে রেখে নার্সিং করে যেতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE