Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ডেঙ্গি-সঙ্কট

উপসর্গ দেখে ডেঙ্গি চিনতে বারবার ভুল, বাড়ছে বিপদ

উপসর্গ অনেকটাই চেনা। তবুও ডেঙ্গি চিনতে এখনও বারবার ভুল হচ্ছে চিকিৎসকদের একাংশের। অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাওয়ার পরে শনাক্ত হচ্ছে রোগটি। অভিজ্ঞ চিকিৎসকও রোগ শনাক্তের ক্ষেত্রে ভুল করে বসছেন। চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হওয়ায় বিপদও বাড়ছে রোগীর। রোগটা একই। তা হলে কেন এমন হচ্ছে? পরজীবী গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ডেঙ্গি ভাইরাস মূলত চার রকমের (ডেং-১, ডেং-২, ডেং-৩ এবং ডেং-৪)। তার মধ্যে কলকাতার পরিচিত হল ডেং-১, ডেং-২ এবং ডেং-৪।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৪০
Share: Save:

উপসর্গ অনেকটাই চেনা। তবুও ডেঙ্গি চিনতে এখনও বারবার ভুল হচ্ছে চিকিৎসকদের একাংশের। অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাওয়ার পরে শনাক্ত হচ্ছে রোগটি। অভিজ্ঞ চিকিৎসকও রোগ শনাক্তের ক্ষেত্রে ভুল করে বসছেন। চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হওয়ায় বিপদও বাড়ছে রোগীর।

রোগটা একই। তা হলে কেন এমন হচ্ছে? পরজীবী গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ডেঙ্গি ভাইরাস মূলত চার রকমের (ডেং-১, ডেং-২, ডেং-৩ এবং ডেং-৪)। তার মধ্যে কলকাতার পরিচিত হল ডেং-১, ডেং-২ এবং ডেং-৪। কলকাতাবাসীর শরীর খুব সহজেই এই তিন প্রজাতির ডেঙ্গি ভাইরাসকে চিনতে পারে। ফলে, ওই তিন ভাইরাস শরীরে ঢুকলে যে উপসর্গ হয়, তা চিকিৎসকদের সকলেরই জানা।

কিন্তু ২০১২ সালে দেখা গেল, এমন ডেঙ্গির জীবাণু মহানগরবাসীর শরীরে ঢুকছে যার ফলে শরীরে অন্য রকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। ডেঙ্গির যে সাধারণ উপসর্গ, তা দেখা যাচ্ছে না। গা হাত-পা ব্যথা নেই। গায়ে চাকা চাকা লালচে দাগ নেই। জ্বরের রোগী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। রক্ত পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্লেটলেট হঠাৎ করে নেমে গিয়েছে ১০—১২ হাজারে। তার পরে ডেঙ্গির পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ওই ব্যক্তির ডেঙ্গিই হয়েছে। আসলে ভাইরাসটির সংক্রমণের তীব্রতা এত বেশি যে, শরীর তাকে চিহ্নিত করার আগেই সে অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে।

বেলেঘাটার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর গবেষকেরা শেষ পর্যন্ত এই উপসর্গহীন ডেঙ্গির রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। আক্রান্তদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে তাঁরা দেখেছেন, নতুন ভাইরাসটি ডেং-থ্রি প্রজাতির। এই প্রজাতির ডেঙ্গি ভাইরাসকে কলকাতাবাসীর শরীর চেনে না। ২০১৩ সালে কলকাতা ও আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গি সংক্রমণের হার ছিল অনেকটাই কম। কিন্তু এ বার ফের ডেঙ্গি ফিরে এসেছে অনেকটা ২০১২ সালের মেজাজেই। চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা বলছে, রোগ যখন ধরা পড়ছে তখন দেখা যাচ্ছে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। প্লেটলেট নেমে গিয়েছে ২০ হাজারের তলায়।

পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ২০০৮-২০০৯ সালে কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে যে ডেঙ্গি হানা দিয়েছিল, তার মূলে ছিল ডেঙ্গি ভাইরাসের তিনটি প্রজাতি। ডেং-ওয়ান, ডেং-টু এবং ডেং-ফোর। ওই তিনটি প্রজাতির ভাইরাসে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। তাই ২০১২ সালে সংক্রমণের তীব্রতা দেখে চিন্তায় পড়েছিলেন তাঁরা। ভাইরাসটির পরিচয় জানার পরে চিকিৎসকদের আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা। তাঁরা বলছেন, ডেং-থ্রি ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনও কলকাতাবাসীর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) তৈরি হয়নি। তাই এলাইজা পরীক্ষাতেও অনেক সময়ে ধরা পড়ে না জীবাণুর উপস্থিতি। নাইসেডের এক পরজীবী বিজ্ঞানী বলেছেন, “২০০৫ সালে রাজ্যে যে ডেঙ্গি ভাইরাসটি হানা দিয়েছিল, সেটিও ডেং-থ্রি প্রজাতির। সে বারও সংক্রমণের তীব্রতা ছিল অনেকটা এ বারের মতোই।”

এই নতুন ধরনের জীবাণুর সঙ্গে লড়াই কররার জন্য চটজলদি রোগ নির্ণয় পদ্ধতির উপরে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যে সব এলাকা ডেঙ্গি প্রবণ, সেখানে এনএস-১ পদ্ধতিতে প্রাথমিক ভাবে রোগটি নির্ণয় করে ফেলতে পারলে চিকিৎসার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়।

যে কোনও ভাইরাস মানব শরীরে ঢুকলে কোষের মধ্যে সেগুলি বিভাজিত হতে শুরু করে। সেই সময়ে ওই সব ভাইরাস থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন নির্গত হয়। সেই সব প্রোটিনকে বলে ননস্পেসেফিক প্রোটিন। ডেঙ্গি জীবাণুর ক্ষেত্রে যে সব নন স্পেসেফিক প্রোটিন নির্গত হয়, সেগুলিকে শনাক্তকরণের পদ্ধতি রয়েছে। রক্তের নমুনায় ওই প্রোটিনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেলেই ধরে নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গি সংক্রমণ হয়েছে। ডেঙ্গি সংক্রমণ নিশ্চিত হতে গেলে অবশ্য এলাইজা পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। তবে এই পরীক্ষার ফল মিলতে সময় নেয় অনেকটা। অনেক সময়ে রোগীর অবস্থা এতটাই খারাপ থাকে যে, এলাইজা পরীক্ষার ফলের জন্য অপেক্ষা করা যায় না।

দ্রুত রোগ নির্ণয়ের জন্য এনএস-১ পরীক্ষা দরকারি বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকে মনে করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিংবা কলকাতা পুরসভা তা মনে করে না। তারা একমাত্র এলাইজা পরীক্ষার ফলকেই মান্যতা দিচ্ছে। পুরসভা নির্দেশিকা প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছে, এলাইজা পরীক্ষায় জীবাণু না পাওয়া গেলে কোনও ব্যক্তিকে ডেঙ্গি রোগী বলা যাবে না। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকেই এনএস-১ পরীক্ষা করিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করানোর পক্ষপাতী। এর ফলে রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা কমে বলেই মনে করেন এই সব চিকিৎসক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dengue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE