Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
হিমোফিলিয়া

ওষুধ আছে, তাও মেডিক্যালে যেতে চান না আক্রান্তরা

হাইকোর্টের নির্দেশে হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিত্‌সার জন্য ওষুধ মজুত করা হয়েছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অথচ সেখানে যেতে চাইছেন না রোগীরা। তাদের বক্তব্য, ওষুধ নিতে গেলেই ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। তিন চার দিন হাসপাতালে ফেলে রাখতে হচ্ছে রোগীকে। চিকিত্‌সকেরা সময় মতো আসেন না। একে ওকে ধরে ব্যবস্থা করলে তবে চিকিত্‌সা পান রোগীরা। অথচ ওই রোগীদের সমস্যা হলে চটজলদি চিকিত্‌সা দরকার।

সৌমিত্র কুণ্ডু
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪০
Share: Save:

হাইকোর্টের নির্দেশে হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিত্‌সার জন্য ওষুধ মজুত করা হয়েছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অথচ সেখানে যেতে চাইছেন না রোগীরা। তাদের বক্তব্য, ওষুধ নিতে গেলেই ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। তিন চার দিন হাসপাতালে ফেলে রাখতে হচ্ছে রোগীকে। চিকিত্‌সকেরা সময় মতো আসেন না। একে ওকে ধরে ব্যবস্থা করলে তবে চিকিত্‌সা পান রোগীরা। অথচ ওই রোগীদের সমস্যা হলে চটজলদি চিকিত্‌সা দরকার।

হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিত্‌সার জন্য ১২-১৩ হাজার টাকা দামের ইঞ্জেকশন, প্রয়োজনীয় চিকিত্‌সা পরিষেবা দিতে গত আট মাস ধরে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিখরচায় ওই সমস্ত দামি ইঞ্জেকশন, ওষুধ রোগীরা পাবেন। অথচ রোগীরা আসছেন না। রোগীর পরিবারের লোকদের একাংশ এবং শিলিগুড়ি হিমোফিলিয়া সোসাইটির কর্মকর্তারা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দুষেছেন। তাঁদের অভিযোগ, বিপদে পড়ে রোগীদের যখন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাঁদের হেনস্থা হতে হচ্ছে। ভর্তি না হলে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় না।

কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত দেড় বছরের দীপ সরকারকে গত ৫ জুলাই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাঁর মা সাবিত্রী দেবীর অভিযোগ, সেখানে তাকে ভর্তি করিয়ে ৪ দিন ফেলে রাখা হয়েছিল। চিকিত্‌সকদের বারবার অনুনয় করে অনেক কষ্টে চিকিত্‌সার ব্যবস্থা করতে হয়।” একই রকম অভিযোগ, আলিপুরদুয়ারের যশোডাঙার বাসিন্দা রতনবাবু, দার্জিলিঙের কিরণ গুরুঙ্গদের। রতনবাবুর ছেলে ৯ বছরের দীপ হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত। রতনবাবু বলেন, “ছেলেকে ১১ বার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। দামি ইঞ্জেকশন কেনার ক্ষমতা আমাদের নেই। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ওই ওষুধ কখনও পাইনি। হিমোফিলিয়া সোসাইটি থেকে কিনে আনতে হয়। সমস্যা হলে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিত্‌সককে দিয়ে তা দেওয়ার ব্যবস্থা করি।” মেডিক্যালে পরিষেবা ঠিক মতো মেলে না দেখে গত আট-ন’ মাস তাঁরা আর যাননি।

স্বাস্থ্য দফতর এবং হিমোফিলিয়া সোসাইটি সূত্রে জানা গিয়েছে, হিমোফিলিয়া রোগীদের চিকিত্‌সা পরিষেবা দিতে সরকারি স্তরে উদ্যোগ ছিল না আগে। এ ব্যাপারে জনস্বার্থে মামলা হয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টে। আদালত রাজ্য সরকারকে ওই রোগীদের চিকিত্‌সার জন্য ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। এর পরেই বছরখানেক ধরে রাজ্যের ৮ টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হিমোফিলিয়া আক্রান্তদের চিকিত্‌সার জন্য ইঞ্জেকশন এবং পরিষেবার ব্যবস্থা করতে তোড়জোড় শুরু করে স্বাস্থ্য দফতর। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাগুলিতে হিমোফিলিয়া রোগীদের সংখ্যা শতাধিক। পরিষেবা দিতে হাসপাতালের চিকিত্‌সক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের গাফিলতিতেই রোগীরা আসছেন না জেনে বিব্রত কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের সুপার সব্যসাচী দাস বলেন, “হিমোফিলিয়ায় আক্রান্তদের জন্য দামি ইঞ্জেকশন, চিকিত্‌সা পরিষেবার ব্যবস্থা গত ৮ মাস ধরে এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করা হয়েছে। রোগীরা এখানে চিকিত্‌সা করাতে আসবেন বলে যে প্রত্যাশা ছিল সেই মতো তাঁরা আসছেন না। কেন এটা হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছি। কেন না এত দামি ইঞ্জেকশন নিখরচায় পেতে পারবেন জেনেও কেন রোগীরা আসবেন না। নিশ্চয়ই কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে।” হিমোফিলিয়া সোসাইটির যে অভিযোগ, সে ব্যাপারে সুপারের বক্তব্য, “এ ধরনের কিছু হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” রোগীদের হাসপাতালে আসা থেকে বিরত করতে চিকিত্‌সক, স্বাস্থ্য কর্মীদের একাংশ জড়িত কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সচেতনতা প্রচারে নামতে উদ্যোগী মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

চিকিত্‌সকরা জানান, এই রোগে দেহের কাটা, ছড়ে যাওয়া যোগ দিয়ে অনর্গল রক্তক্ষরণ হতে থাকে। শরীরের বিভিন্ন অংশে বিশেষত হাটু, গোড়ালি, কনুইয়ের মতো অংশে শরীরের ভিতরে রক্ত ক্ষরণ হয়ে ফুলে যায়। তীব্র ব্যথা করে।

পরিস্থিতি থেকে রোগীকে স্বস্তি দিতে বিশেষ ইঞ্জেকশন (ফ্যাক্টর-৮ এবং ফ্যাক্টর-৯) দেওয়া হয়। যার এক একটি অ্যাম্পুল বা ডোজের দাম ১২-১৩ হাজার টাকা। শরীরে ব্যথা, রক্তক্ষরণ হলে তখনই ইঞ্জেকশন নেওয়া দরকার। সেই মতো ৪ থেকে ৫ টি ইঞ্জেকশন নিতে হয়। সেই খরচও অনেক। ওষুধও সব জায়গায় মেলে না। উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি হিমোফিলিয়া সোসাইটি রয়েছে। তারাই ওই ওষুধ এ দিন রোগীদের সরবরাহ করতেন। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান উদয় শঙ্কর জানান, রোগীদের আসার সংখ্যা খুবই কম। মাসে ১টা দুটো। ওষুধ স্টোরে থাকে। সকালের দিকে রোগী এলে সেই মতো ওষুধ বার করা হয়। বিকেল চারটের পর কোনও রোগী এলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তখন স্টোর বন্ধ হয়ে যায়। তবে রোগীদের বিপদমুক্ত করতে প্লাজমা দেওয়া হয়। পরের দিন ফ্যাক্টর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। রোগীর সংখ্যা বাড়লে ওষুধ সেই মতো বাইরে রাখা যাবে। তখন সমস্যা হবে না বলে ধারণা উদয়বাবুর। এরকমই মনে করছেন শিশু বিভাগের প্রধান মৃদুলা চট্টোপাধ্যায়ও। হিমোফিলিয়া সোসাইটির সম্পাদক মাণিকলাল মিত্রুকা বলেন, “মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত ৫ মাসে আমরা ২০ জন গরিব রোগীকে পাঠিয়েছিলাম। তাঁদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সেখানে তাঁদের ভর্তি করিয়ে রাখা হচ্ছে। চার-পাঁচ দিন ধরে চিকিত্‌সা হচ্ছে না। অনেকে ফিরে এসেছেন। পরে আর যেতে চাননি। কেন না রোগীর ব্যথা বা রক্ত ক্ষরণ হলে দ্রুত ইঞ্জেকশন দেওয়া দরকার। তা দিতে দেরি হলে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হবে। রোগীর দুর্ভোগ বাড়বে।” সচেতনতা প্রচার দরকার বলে তারা জানিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE