Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

কেনা জলে হাত পরিষ্কার, খাওয়ার বেলায় বিষাক্ত জল

সার সার মিনারেল ওয়াটারের জলের ড্রাম সাজানো। সেখান থেকে জল তুলে তুলে ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধুতে বলা হচ্ছে। সাবান এগিয়ে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। কাজ সারা হলে হাতে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রিস্ট ব্যান্ড। সব দেখেশুনে তির্যক হাসলেন এক অভিভাবক। বললেন, ‘‘সারা বছর আর্সেনিকমুক্ত জল ব্যবহার করতে বাধ্য হই আমরা। এক দিনের জন্য কেনা জল এনে স্বাস্থ্যবিধি শিখিয়ে কী লাভ!’’

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:১৮
Share: Save:

সার সার মিনারেল ওয়াটারের জলের ড্রাম সাজানো। সেখান থেকে জল তুলে তুলে ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধুতে বলা হচ্ছে। সাবান এগিয়ে দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। কাজ সারা হলে হাতে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রিস্ট ব্যান্ড।

সব দেখেশুনে তির্যক হাসলেন এক অভিভাবক। বললেন, ‘‘সারা বছর আর্সেনিকমুক্ত জল ব্যবহার করতে বাধ্য হই আমরা। এক দিনের জন্য কেনা জল এনে স্বাস্থ্যবিধি শিখিয়ে কী লাভ!’’

শুক্রবার বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসে বসিরহাটের ইছামতী নদীর অন্য পাড়ে শিবহাটিতে গিয়ে জানা গেল, গত কুড়ি বছরে অন্তত ৩৫-৪০ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। আজও বহু মানুষ গায়ে আর্সেনিকের দগদগে ঘা নিয়ে জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে শিবহাটি, মেরুদণ্ডী, আধানি গ্রামে বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। কেমন আছেন, জানতে গেলে মানুষ তেড়ে আসেন। সকলেরই এক রা, ‘‘এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানীয় জল দিতে পারবেন না যখন, কেন বার বার আমাদের বিরক্ত করতে আসেন!’’

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি রহিমা বিবি অবশ্য নতুন আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি জানান, শুধু বসিরহাটের ওই এলাকাই নয়, গোটা সুন্দরবনে যে সব জায়গায় জলে আর্সেনিকের সমস্যা আছে, তার সমাধানের চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কথাও হয়েছে। ছোটখাট স্থানীয় ভাবে কাজ না করে বড়সড় পাইলট প্রজেক্টের কথা ভাবছেন মন্ত্রী। রহিমা বিবির কথায়, ‘‘আশা করছি, খুব শীঘ্রই এই প্রজেক্ট চূড়ান্ত করে কাজ শুরু করা যাবে।’’

বসিরহাট শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতী নদীর অন্য পাড়ে সংগ্রামপুর-শিবহাটি পঞ্চায়েত। সেখানকার অধিকাংশ এলাকার জলে ভয়াবহ মাত্রায় আর্সেনিক। সেই জলই খেতে বাধ্য হন মানুষ। স্নান, রান্না আর যাবতীয় কাজ চলে সেই জলেই। ২০০৬ সালে শিবহাটি স্লুইস গেটের পাশে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আর্সেনিক রিমুভাল প্ল্যান্টের শিলান্যাস করা হয়েছিল বটে, কিন্তু পরবর্তি সময়ে কাজ বিশেষ এগোয়নি। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, যেখানে আর্সেনিকের মাত্রা প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি থাকার কথা নয়, সেখানে এই এলাকার কোথাও প্রতি লিটারে আর্সেনিকের মাত্রা ০.৬৩২ মিলিগ্রাম, ০.৪৬ মিলিগ্রাম, ০.৬৯ মিলিগ্রাম। যাদবপুর এসআইএস এবং ব্রেক থ্রু সায়েন্স সোসাইটি, শিবপুর বিই কলেজের পক্ষ থেকে এলাকার জল পরীক্ষায় ৯৯ শতাংশ নলকূপে তীব্র মাত্রায় আর্সেনিক মিলেছে। বিভিন্ন সময়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে নানা ধরনের প্রকল্পে কল পোঁতা হলেও সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

• কামারডাঙায় আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের পাইপ পুঁতেই দায় সারা হয়েছে।

• শরৎকালে বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখার প্রকল্পের কাজ এগোয়নি।

• আধানি প্রাথমিক স্কুলের মাঠে তৈরি হওয়া আর্সেনিক রিমুভাল প্ল্যান্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

• এক হাজারের উপরে টিউবয়েল বসানো হলেও তার অস্তিত্ব নেই।

এ দিন শিবহাটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, হাসপাতাল চত্বরে থাকা ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ২০০৮ সালে সজলধারা প্রকল্পে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যা বর্তমানে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তার পাশে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্লক মেডিক্যাল অফিসার সৌরভ বণিক বললেন, ‘‘এলাকার জলে প্রচণ্ড পরিমাণে আর্সেনিক থাকায় রোগী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরকারি ভাবে ফিল্টার বসানো হয়েছে। আমরা ওই জলই খাই।’’ কিন্তু হাসপাতালের কর্মী কিম্বা রোগীরা না হয় ফিল্টারের জল খেলেন, কিন্তু গোটা পঞ্চায়েত এলাকার মানুষ কী খাবেন? নার্স জয়ন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, এএনএম ডালিয়া মুখোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘আর্সেনিক যুক্ত জল খেয়ে গত এক বছরের মধ্যে আধানি গ্রামের রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, বিকাশ সর্দারের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের এক আশাকর্মী-সহ বহু মানুষ আক্রান্ত। আলোচনা ও প্রকল্পের বিরাম নেই। কিন্তু পরিস্রুত পানীয় জলের সুরাহা হয়নি। তাই হাত ধোয়ার পাশাপাশি আর্সেনিক মুক্তির জন্য কিছু করা হলে এখানকার মানুষ বেঁচে যেতেন।’’

শিবহাটি বাজার ইউনিয়নের সম্পাদক মোহন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বিশ্ব হাত ধোওয়া দিবসের লক্ষ্য, মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। নির্মল বাংলা গড়া। কিন্তু আমরা এখানে পানীয় জলের নামে বিষ খাচ্ছি। তাই আমাদের কাছে হাত ধোওয়া দিবসের গুরুত্ব কতটুকু বোঝাই যায়!’’ পিঠে আর্সেনিকের ঘা দেখিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্য শচীন পাত্র জানালেন তাঁর হতাশার কথা।

জানা গেল, কামারডাঙায় আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের পাইপ পুঁতেই দায় সারা হয়েছে। শরৎখালে বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখার প্রকল্পের কাজ এগোয়নি। আধানি প্রাথমিক স্কুলের মাঠে তৈরি হওয়া আর্সেনিক রিমুভাল প্ল্যান্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এক হাজারের উপরে টিউবয়েল বসানো হলেও তার অস্তিত্ব নেই।

জল নিয়ে যন্ত্রণায় জেরবার মানুষ তাই বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসে সরকারি ডাকে হাজির হলেও আগাগোড়া থাকলেন গোমড়া মুখেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE