Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

চারশো স্বাস্থ্যকর্মীর বেতন বন্ধ, ম্যালেরিয়া রুখবে কে

জঙ্গলমহল থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসন্ন ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি মরসুমে রোগ নির্ণয়, মোকাবিলা এবং প্রতিরোধের কাজ আদৌ চালানো যাবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে স্বাস্থ্য দফতর। কারণ, এই কাজ যাঁরা করতেন রাজ্যের সেই ৪০০ পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর খাতায়-কলমে গত ৩১ মার্চ-এর পর বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ০২:১০
Share: Save:

জঙ্গলমহল থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসন্ন ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি মরসুমে রোগ নির্ণয়, মোকাবিলা এবং প্রতিরোধের কাজ আদৌ চালানো যাবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে স্বাস্থ্য দফতর। কারণ, এই কাজ যাঁরা করতেন রাজ্যের সেই ৪০০ পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর খাতায়-কলমে গত ৩১ মার্চ-এর পর বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য দফতর সুত্রের খবর, অস্থায়ী হলেও এই ৪০০ পদ মন্ত্রিসভা অনুমোদিত। ২০১০ সাল থেকে এঁরা কাজ শুরু করেন। বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সাহায্য থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এঁদের প্রায় ১৩৫০০ টাকা বেতন দিত। সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্কের সেই প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় কেন্দ্র হাত গুটিয়ে নিয়েছে। বেতনের ব্যবস্থা করতে পারেনি রাজ্যও।

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “এখনই আমরা সরকারি ভাবে ওঁদের বরখাস্ত করছি না। কেন্দ্র যাতে আরও ছ’মাস ওই ৪০০ জনের বেতন দেয়, তার জন্য দিল্লিতে চিঠি লেখা হয়েছে।” ওই কর্মীরাও পাল্টা বলছেন, “রাজ্য আমাদের হাতে চাকরি যাওয়ার চিঠিও ধরাচ্ছে না, আবার বেতনের ব্যবস্থাও করছে না। শুধু কেন্দ্র দেখাচ্ছে। আসলে আমাদের ছাড়া রোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে না বুঝে রাজ্য ভয় পেয়ে কৌশলী হচ্ছে। আমাদের ঝুলিয়ে রাখছে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তারা যদি ভাবেন, বিনা বেতনে আমরা বোকার মতো পরিষেবা দিয়ে যাব তা হলে ভুল হবে।”

স্বাস্থ্যকর্তারাই স্বীকার করছেন, এই কর্মীদের ছাড়া রাজ্যের সাত জেলায় প্রধানত পতঙ্গবাহিত রোগের চিকিৎসা কী ভাবে সামলানো যাবে তা ভেবে তাঁরা কুলকিনারা পাচ্ছেন না। কারণ বিনপুর, বেলপাহাড়ি, রানিবাঁধ, বান্দোয়ান, বাঘমুণ্ডি, খাতড়া, সারেঙ্গা, আড়শা, ঝালদা, জয়পুর, মেটেলি, নাগরাকাটা, মাল, দিনহাটার মতো যে সব দূরবর্তী এলাকায় নিরাপত্তার কারণে মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা যায়নি, সেখানে ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করতেন। কিন্তু জঙ্গলমহলের ম্যালেরিয়াপ্রবণ বেলপাহাড়ি ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীরা আর যাচ্ছেন না বলে বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন।

বেলপাহাড়ির পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা পাথরচাড়ি, শাঁখাভাঙা, জুবিজড়মা, বীরমাদল, ঢাঙিকুসুম, জবলার মতো গ্রামগুলিতে প্রায়ই জ্বরে আক্রান্ত হন বাসিন্দারা। লবনি গ্রামের অধরচন্দ্র সর্দার, শাঁখাভাঙার সুধীর ভূমিজ, ঢাঙিকুসুমের মঙ্গল শবরদের কথায়, “স্বাস্থ্যকর্মীরা আসছেন না বলে আমরা পতঙ্গবাহিত রোগের প্রতিষেধক পাচ্ছি না। মার্চ মাসে জবলা গ্রামে এক বৃদ্ধা সহ দু’জনের মৃত্যু হয়। টাকা বন্ধ হয়েছে বলে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করতে চাইছেন না। তাই আক্রান্তদের রক্ত পরীক্ষার সুযোগ হয়নি।” বাঁকুড়ার সারেঙ্গা, জয়পুরের একাধিক ব্লকের বাসিন্দাদের অভিযোগ, “পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীরা আসছেন না বলে ম্যালেরিয়া-আক্রান্তদের সময় মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।”

গত ৭ এপ্রিল স্বাস্থ্যভবনে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অনুষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্তারা খোলাখুলিই জানিয়েছিলেন, পতঙ্গবাহিত রোগের তথ্য এই সব জেলার প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে স্বাস্থ্য ভবনে ঠিক সময়ে এসে পৌঁছচ্ছে না। তার কারণ যথেষ্ট কর্মীর অভাব। এরই মধ্যে আবার পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৫ জনের রক্তে ফ্যাসলিপেরাম ম্যালেরিয়ার ভাইরাস ধরা পড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিভাগের যুগ্ম অধিকর্তা সচ্চিদানন্দ সরকারের কথায়, “রাজ্যে স্বাস্থ্যকর্মী এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় কম। তার উপরে এই পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ বন্ধ হলে রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা পরিষেবায় ধাক্কা লাগবেই।” কারণ, এই কর্মীরাই পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের মতো একাধিক জেলায় দুর্গমতম এলাকায় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে সচেতনতা বাড়ানো, মশারি বিতরণ, রক্তের স্লাইড সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে আসা, রিপোর্ট সংগ্রহ করে চিকিৎসককে দেখানো এবং চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ রোগীর কাছে পৌঁছনোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, কালাজ্বর, জাপানিজ এনসেফ্যালাইটিসের পাশাপাশি কোথাও ডায়রিয়া বা অজানা জ্বর দেখা দিলেও সেই তথ্য এঁদেরই মারফত স্বাস্থ্য ভবনে আসত। অনেক ক্ষেত্রে যক্ষ্মারোগীদের এঁরাই ডটস-এর ওষুধ খাওয়াতেন।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এঁদের কাজ যখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং এমনিতেই যখন স্বাস্থ্যকর্মীর আকাল তখন একসঙ্গে ৪০০ জনের চাকরি গেল কেন? কেন রাজ্য সরকার তাঁদের রাখার চেষ্টা করল না? সচ্চিদানন্দবাবুর উত্তর, “বিষয়টা আমাদের হাতে নেই। বেতন আমরা দিতাম না, কেন্দ্র দিত। ওরা বেতন বন্ধ করেছে।” কেন্দ্রে পতঙ্গবাহিত রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রমের অধিকর্তা অক্ষয়কুমার ধারিওয়াল পাল্টা বলেন, “প্রায় ১২০০ পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর পদ তৈরি হওয়ার পরেও পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘদিন তাতে নিয়োগ করেনি। আমরা তবু উদ্যোগী হয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের টাকা থেকে ৪০০ লোক নিই। এখন বিশ্বব্যাঙ্ক টাকা না-দিলে আমরা অপারগ।” এর জবাবে রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, তিন-চার মাসে আগে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন, কেন্দ্র বেতন বন্ধ করতে চলেছে। তখনই রাজ্য থেকে ওই কর্মীদের বেতন দেওয়ার ব্যাপারে অর্থ দফতরে ফাইল পাঠানো হয়। তার মধ্যে নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। অর্থ দফতর ফাইল ফেরত পাঠিয়ে জানিয়ে দেয়, যা হবে সব নির্বাচনের পরে। ফলে এখন অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bondhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE